প্রতিনিধি ৯ এপ্রিল ২০২৩ , ২:২১:০১
দৈনিক হক কথা নাম করণ প্রসঙ্গ-দেশ বর্তমানে একটি সংকটময় মুহূর্ত পারি দিচ্ছে।বর্হিবিশ্ব বাংলাদেশ নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এটা নতুন কিছু নয়।আমরা “হক কথা” পরিবার আশা করি সরকার দেশ ও জনগণের কথা বিবেচনা করে দেশে নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করবে।
দেশের এই ক্রান্তিকালে দেশ ও জনগণের পক্ষে হক কথা বলার মানুষ,সাংবাদিক বা গণমাধ্যমের খুব অভাব আর সে চিন্তা থেকেই আমাদের ‘দৈনিক হক কথা’।
আমরা চাই জনগণের মাঝে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ উপস্থাপন করতে।দেশের সকলের সহযোগিতা কাম্য।
মাওলানা ভাসানীও ছিলেন সত্য ও ন্যায়বান মানুষ।
মাওলানা ভাসানী সারা জীবনই ছিলেন মেহনতি মানুষের পক্ষে আর আমাদের সমাজে মেহনতি-বঞ্চিত মানুষের পক্ষে কথা বলাই মানে তাঁকে বলা হয় বিদ্রোহী। তাই অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মাওলানা ভাসানীকে তুলনা করেছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি তাঁর এক প্রবন্ধে বলেন, ‘মওলানা সমগ্র জীবনভর বিদ্রোহী ছিলেন, যেমন বিদ্রোহী ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। একজন রাজনীতিতে, অপরজন সাহিত্যে। মানুষের বঞ্চনা তাঁরা উভয়ে দেখেছেন, ক্ষমতা ছিল না উপলব্ধিকে অবদমিত করেন, তাই আবেগের উদ্বেলিত শক্তিকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করে তাঁরা অসাধারণ হয়ে উঠেছেন। তাঁদের পটভূমিতে ও প্রস্তুতিতে অকিঞ্চিৎকরতা ছিল। স্বাভাবিক ছিল তাঁদের পক্ষে সংখ্যাহীন মানুষের স্রোতে একটি সংখ্যা হয়ে যাওয়া। তাঁরা তা হননি। আবেগ তাঁদের অসামান্য করলো, করলো সাহসী, করলো বিদ্রোহী, করলো বিপ্লবী।’ ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬ সালে তার সাপ্তাহিক ‘হক-কথা’য় প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, মাওলানা ভাসানী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভক্ত ছিলেন এবং খুব সমাদর করতেন।
কে ছিলেন মাওলানা ভাসানী? সংক্ষিপ্ত জীবনী-
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (১২ ডিসেম্বর ১৮৮০ – ১৭ নভেম্বর ১৯৭৬) তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে “মজলুম জননেতা” হিসাবে সমধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন বিংশশতকী ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম তৃণমূল রাজনীতিবিদ ও গণআন্দোলনের নায়ক। সারা রাজনৈতিক জীবনে তিনি প্রচুর প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী ছিলেন এবং বেশ কিছু সাধারণ ও স্থানীয় নির্বাচনে জয়ীও হয়েছিলেন, তবে কখনও ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেন নি। তাঁর নেতৃত্বের ভিত্তি ছিল কৃষক শ্রমিক জনসাধারণ, যাদের অধিকার এবং স্বার্থ রক্ষার জন্য তিনি নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম করে গেছেন।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের ধানগড়া পল্লীতে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা হাজী শারাফত আলী। হাজী শারাফত আলী ও বেগম শারাফত আলীর একটি মেয়ে ও তিনটি ছেলের সবার ছোট মোঃ আব্দুল হামিদ খান। ছেলে-মেয়ে বেশ ছোট থাকা অবস্থায় হাজী শারাফত আলী মারা যান। তাঁর ডাক নাম ছিল চেগা মিয়া। পিতৃহীন হামিদ প্রথমে কিছুদিন চাচা ইব্রাহিমের আশ্রয়ে থাকেন। ওই সময় ইরাকের এক আলেম ও ধর্ম প্রচারক নাসির উদ্দীন বোগদাদী সিরাজগঞ্জে আসেন। হামিদ তাঁর আশ্রয়ে কিছুদিন কাটান। স্থানীয় স্কুল ও মাদ্রাসায় কয়েক বছর অধ্যয়ন ছাড়া তাঁর বিশেষ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তিনি কর্মজীবন শুরু করেন টাঙ্গাইলের কাগমারিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে। পরে তিনি ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট এলাকার কালা গ্রামে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন।
১৯১৯ সালে ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়।কংগ্রেসে যোগদান করে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯২৫ সালে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর মেয়ে আলেমা খাতুনকে বিবাহ করেন। পরবর্তীতে তিনি বিয়ে করেন হামিদা খানম ভাসানী কে (পীর মা হিসেবে ভুরুঙ্গামারীতে খ্যাত) কামাত আঙ্গারিয়া গ্রামে (বর্তমানে এই গ্রামটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ভাসানী নগর হিসেবে) এটি সীমান্ত ঘেষা একটি অজপাড়াগাঁ। ১৯২৬ সালে তিনি তার সহধর্মিণী আলেমা খাতুনকে নিয়ে আসাম গমন করেন এবং আসামে প্রথম কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটান। ১৯২৯-এ আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। এখান থেকে তার নাম রাখা হয় “ভাসানীর মাওলানা”।এরপর থেকে তার নামের শেষে “ভাসানী” শব্দ যুক্ত হয়।
১৯৩১-এ সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২-এ সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায় ও ১৯৩৩-এ গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলন করেন। ১৯৩৭ সালে ভাসানী মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং অচিরেই দলের আসাম শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। এ ভৌগোলিক বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে আসামের মুখ্যমন্ত্রী স্যার মোহাম্মদ সাদউল্লাহ্র সঙ্গে মওলানা ভাসানীর সংঘর্ষ বাঁধে। ভারত বিভাগের সময় ভাসানী আসামের গোয়ালপাড়া জেলায় এ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। আসাম সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে এ শর্তে মুক্তি দেয় যে, তিনি আসাম ছেড়ে চলে যাবেন। ১৯৪৮-এ মুক্তি পান। এরপর তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে ফিরে আসেন। ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতায় পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন ছাত্র নিহত হন। ভাসানী এর কড়া প্রতিবাদ করেন এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁকে তাঁর গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। রাজনৈতিকভাবে ভাসানী এতে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে ভাসানী সবচেয়ে প্রতিবাদী এবং শ্রদ্ধেয় রাজনীতিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে ভাসানী তখনকার পাঁচটি বিরোধী দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নামে একটি মোর্চা গঠন করেন। এ মোর্চার অপরাপর নেতা ছিলেন এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান ও হাজী মোহাম্মদ দানেশ। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন লাভ করে এবং মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৭টি আসন।
বারবার কারাবরণের ফলে কারাগারে কমিউনিস্টদের সঙ্গে মওলানার যোগাযোগ ঘটে এবং তিনি সমাজতান্ত্রিক মতবাদ সম্পর্কে আরও সচেতন হয়ে ওঠেন। কমিউনিস্টরা তাঁকে আদমজী জুটমিল মজদুর ইউনিয়নের এবং পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে এমপ্লয়ীজ লীগের সভাপতি করে। ১৯৫৪ সালের মে দিবসে তিনি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে দুটি বৃহৎ শ্রমিক সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন। ঐ বছরই তিনি পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির সভাপতি হন। এর কিছুদিন পর তিনি কমিউনিস্ট প্রভাবিত আন্তর্জাতিক শান্তি কমিটির পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি পদে আসীন হন এবং স্টকহোমে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন। এ সুযোগে তিনি ইউরোপের বহু দেশ ভ্রমণ করে বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করেন।
ইতোমধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং কৃষক শ্রমিক পার্টির দ্বন্দ্বের কারণে যুক্তফ্রন্ট ভাঙনের সম্মুখীন হয়। আপ্রাণ চেষ্টা করেও তিনি এ দ্বন্দ্ব মেটাতে পারেন নি। এদিকে ১৯৫৬ সালে কেন্দ্রে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী মুসলিম লীগ কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন। সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হন এবং আতাউর রহমান খানকে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের ব্যাপারেও সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মওলানার মতবিরোধ দেখা দেয়। প্রস্তাবিত পাকিস্তান সংবিধানে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মওলানা তীব্র প্রতিবাদ করেন। সোহরাওয়ার্দী পৃথক নির্বাচনের পক্ষপাতি ছিলেন। মওলানা তাঁর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘেষা বৈদেশিক নীতিরও বিরোধিতা করেন। তিনি চেয়েছিলেন চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে।
মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালে কাগমারিতে আওয়ামী লীগের এক সম্মেলন আহবান করেন। ঐ সম্মেলনে তিনি সোহরাওয়ার্দীর বৈদেশিক নীতির তীব্র বিরোধিতা করেন। এ মতবিরোধের কারণে দলে ভাঙন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঐ বছর মওলানা ভাসানী ঢাকায় পাকিস্তানের সকল বামপন্থি দলের একটি সম্মেলন আহবান করেন এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন দল গঠন করেন। তিনি এ দলের সভাপতি হন এবং এর সেক্রেটারি জেনারেল হন পশ্চিম পাকিস্তানের মাহমুদুল হক ওসমানী। এ সময় থেকে মওলানা প্রকাশ্যে বামপন্থি রাজনীতি অনুসরণ করতে থাকেন।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আইয়ুব খান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করলে মওলানাকে আবার আটক করা হয়। ১৯৬৩ সালে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর মওলানা চীন ভ্রমণে যান এবং ১৯৬৪ সালে হাভানায় বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি আইয়ুব খানের প্রস্তাবিত মৌলিক গণতন্ত্রীদের দ্বারা গঠিত নির্বাচকমন্ডলীর কঠোর বিরোধিতা করেন এবং প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের পক্ষে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৬৭ সালে বিশ্ব সমাজতন্ত্র সোভিয়েতপন্থি ও চীনপন্থি এ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপও ভাগ হয়, এবং মওলানা চীনপন্থি দলের নেতৃত্বে থাকেন।
তিনি আইয়ুব সরকারকে সাম্রাজ্যবাদের লেজুড় হিসেবে গণ্য করেন এবং আইয়ুব খানকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের জন্য আন্দোলন শুরু করেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং তাঁকে মুক্তি দানের জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। বিরোধীদলের কঠোর আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন এবং সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসীন হন। রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পার্লামেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। মওলানা নির্বাচন বয়কট করে নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড়ে উপকূলীয় অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনে আত্মনিয়োগ করেন। ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলার কারণে মওলানা প্রকাশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা দাবি করেন।
১৯৭০ সালের ৬-৮ আগস্ট বন্যা সমস্যা সমাধানের দাবিতে অনশন পালন করেন। অতঃপর সাধারণ নির্বচনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১২ নভেম্বর (১৯৭০) পূর্ব পাকিস্তানে প্রলয়ঙ্কারী ঘুর্ণিঝড় হলে দুর্গত এলাকায় ত্রাণ ব্যবস্থায় অংশ নেয়ার জন্য ন্যাপ প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাড়ান। ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৭১ এর মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রদান করেন এবং ১৮ জানুয়ারি ১৯৭১ পল্টন ময়দানে অণুষ্ঠিত জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের জন্য তার প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত যান এবং মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন। ২৫ মার্চ রাতে মওলানা ভাসানী সন্তোষে তার গৃহে অবস্থান করছিলেন। তিনি পাকিস্তান বাহিনীর দৃষ্টি এড়িযে টাঙ্গাইল ছেড়ে তার পিতৃভূমি সিরাজগঞ্জে চলে যান। পাকিস্তান বাহিনী তার সন্তোষের বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। মওলানা ভাসানী মোজাফ্ফর ন্যাপ নেতা সাইফুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে নৌকাযোগে ভারত সীমানা অভিমুখে রওনা হন। অবশেষে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর সাহায্যে মওলানা ভাসানী ও সাইফুল ইসলাম ১৫/১৬ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ অতিক্রম করে আসামের ফুলবাড়ী নামক স্থানে উপস্থিত হন। পরে তাদের হলদীগঞ্জ বিএসএফ ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়া হয়। এরপর মওলানা ভাসানী ও সাইফুল ইসলামকে প্লেনে করে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং পার্ক স্ট্রিটের কোহিনুর প্যালেসের ৫তলার একটি ফ্ল্যাট তাদের অবস্থানের জন্য দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে মওলানা ভাসানী একটি বিবৃতি প্রদান করেন যা ভারতীয় বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া মাওলানা ভাসানী চীনের নেতা মাও সে তুং, চৌ এন লাই এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে তার বার্তা পাঠিয়ে তাদের অবহিত করেন যে পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপকহারে গণহত্যা চালাচ্ছে। সেজন্য তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অণুরোধ করেন এই মর্মে যে, তিনি যেন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ না করেন। উপরন্তু মওলানা ভাসানী প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার আহ্বান জানান। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল মাওলানা ভাসানী সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট কাছে পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে বর্বরোচিত অত্যাচার চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অণুরোধ করেন। ৩১ মে মাওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দখলদার বাহিনীর সঙ্গে জীবনমরণ সংগ্রামে লিপ্ত। তারা মাতৃভূমি রক্ষার জন্য বদ্ধপরিকর। তারা এই সংগ্রামে জয়লাভ করবেই। ৭ জুন মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সব অঞ্চল আজ দশ লাখ বাঙালির রক্তে স্নাত এবং এই রক্তস্নানের মধ্য দিয়েই বাংলার স্বাধীনতা আসবে।
এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দু’বার কোহিনুর প্যালেসে এসে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন এবং তার পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রার্থনা করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বদলীয় চরিত্র দেয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে আট সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয় যার সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। ওই উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন – ১) তাজউদ্দীন আহমদ, ২) মণি সিংহ, ৩) অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, ৪) মনোরঞ্জন ধর প্রমুখ। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ওই উপদেষ্টা কমিটির সভায় এই মর্মে অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে, পূর্ববঙ্গের পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতিরেক অন্য কোন প্রকার রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণযোগ্য হবে না।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মওলানা ভাসানী কলকাতা ছাড়াও দেরাদুন, দিল্লী ও অন্যান্য স্থানে অবস্থান করেন। পরবর্তীকালে অনেকে অভিযোগ করেন যে ভারতে থাকাকালীন তিনি নজরবন্দি অবস্থায় ছিলেন। ভারতে অবস্থানকালে মওলানা ভাসানী দুইবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তাকে দিল্লী অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সে ভর্তি করা হয়েছিল।
মাওলানা ভাসানী ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক হক-কথা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করলেও মুজিব সরকারের জাতীয়করণ নীতি এবং ১৯৭২-এর সংবিধানের এর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। ১৯৭৩ সালে খাদ্যের দাবিতে ঢাকায় ১৫-২২ মে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ১৯৭৪-এর ৮ এপ্রিল হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি গঠন করেন। একই বছর জুন মাসে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলে টাঙ্গাইলের সন্তোষে গৃহবন্দি হন। ১৯৭৬-এর ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লং মার্চে নেতৃত্ব দেন। একই বছর ২ অক্টোবর খোদাই খিদমতগার নামে নতুন আর একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। জয়পুরহাট-এর পাঁচবিবিতে মহিপুর হাজী মহসীন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, পরে সেটি জাতীয়করণ করা হয়। আসামে ৩০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কারিগরী শিক্ষা কলেজ, শিশু কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন সন্তোষে। এছাড়াও তিনি কাগমারিতে মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ এবং পঞ্চবিবিতে নজরুল ইসলাম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সন্তোষে “মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়” যা কিনা ২০০২ সাথে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মধ্যে ৩য় স্থান এ আছে।
তার প্রকাশিত গ্রন্থ : ১. দেশের সমস্যা ও সমাধান (১৯৬২) ২.মাও সে তুং-এর দেশে (১৯৬৩)
১৯৭৬ খৃস্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই দেশ বরেণ্য নেতা মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে টাংগাইল জেলার সদর উপজেলার উত্তর-পশ্চিমে সন্তোষ নামক স্থানে পীর শাহজামান দীঘির পাশে সমাধিস্থ করা হয়। সারা দেশ থেকে আগত হাজার হাজার মানুষ তাঁর জানাযায় অংশগ্রহণ করে।
সুত্র: উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া