শিক্ষা

ভুলে ভরা পাঠ্যবই

  প্রতিনিধি ২৩ এপ্রিল ২০২৩ , ৮:১৫:০৮

শেয়ার করুন

রোকেয়োর, সাহাত্য, সবখানইে, সমাজার’ এই ভুল শব্দগুলো ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১১ পৃষ্ঠার ১৫-১৭ নম্বর লাইনে। শুধু এটিই নয়, চলতি শিক্ষাবর্ষ ২০২৩ থেকে চালু হওয়া মাধ্যমিকে ষষ্ঠ এবং সপ্তম দুই শ্রেণির নতুন পাঠ্যবইয়ে প্রায় আড়াইশ ভুল এবং অসঙ্গতি পেয়েছে বিশেষজ্ঞ কমিটি। 

জানা গেছে, চলতি শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম চালু করেছে সরকার। পরীক্ষামূলকভাবে ‘তড়িঘড়ি’ করে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়। এতে নানা ভুল, অসঙ্গতি ও বিভ্রান্তিকর তথ্য উঠে আসে। এ নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এরপর গত ১০ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ’ পাঠ্যপুস্তক দুটি প্রত্যাহার করে নেয় এনসিটিবি। ওই সময় এনসিটিবি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলনী পাঠ’ এবং ষষ্ঠ শ্রেণির ‘বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ’ এবং ‘বিজ্ঞান অনুশীলন’ পাঠ্যবইয়ের কিছু অধ্যায় সংশোধন করার কথা জানানো হলে পরে দুই শ্রেণির সবকটি বইয়েরই ভুল-অসঙ্গতির সংশোধনী দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানায় সংস্থাটি।

পহেলা জানুয়ারি দেশের শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই তুলে দেয় সরকার। কিন্তু সব শিক্ষার্থী এ বই পায়নি। যারা পেয়েছে তারাও সব বই পায়নি।

 

এর কারণ হিসেবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) জানায়, বিভিন্ন সংকটের কারণে তারা যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে পারেনি।

কিন্তু, খোলা বাজারে সহজেই মিলছে নতুন বই। অসাধু কিছু ব্যবসায়ী এসব বই চড়া দামে বিক্রি করছে। শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন যেসব বই তুলে দেয়া হয়েছে, সেসব বইয়ে রয়েছে অসংখ্য ভুল।

ইতিহাস থেকে শুরু করে তথ্য ও পরিসংখ্যানগত ভুল রয়েছে। আছে বানান ও যতি চিহ্নের ভুলও। পাঠ্যপুস্তকে এমন ভুল নিয়ে চলছে সমালোচনা। এরই মধ্যে পাঠ্যবইয়ের ভুল ধরার জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে এনসিটিবি।

 

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানিয়েছেন, নতুন বইয়ে যে ভুল রয়েছে সেগুলো আগামী বছরগুলোতে সংস্কার করা হবে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, এ ধরনের ভুল কাম্য নয়। সংশ্লিষ্টদের এসব বিষয়ে আরও সতর্ক থাকতে হবে। গত বছর পাঠ্যবইয়ে ভুলের জন্য এনসিটিবি চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কড়া সমালোচনা করেন হাইকোর্ট।

 

দেখা যায়, প্রতি বছরই শুরুতে শিক্ষার্থীরা বই না পেলেও খোলাবাজারে পাওয়া যায় এনসিটিবির বই। এরপরও নতুন বইয়ে ভুল ও কালোবাজারি বন্ধে যথেষ্ট উদ্যোগী নয় এনসিটিবি। শনিবার রাজধানীর নীলক্ষেতের বিভিন্ন লাইব্রেরি ও ফুটপাথের বইয়ের দোকানে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের সব শ্রেণিরই নতুন বই পাওয়া যাচ্ছে। দর কষাকষিও করা যাচ্ছে।

 

ফুটপাথের একটি দোকানে নবম-দশম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণের মূল্য চাওয়া হয় ১৮০ টাকা। আর দ্বিতীয় শ্রেণির ইংরেজি ও গণিত বইয়ের দাম চাওয়া হয় ২৫০ টাকা।

 

বিক্রেতারা জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাওয়া না গেলেও আমাদের কাছে সব শ্রেণির বই-ই পাওয়া যায়। কোনোটি না থাকলে ম্যানেজ করে দেয়া যাবে। কিন্তু কোথা থেকে এসব বই হাতে আসছে, তা জানাতে অস্বীকৃতি জানান তারা।

 

পাঠ্যবইয়ে ভুলের বিষয়ে এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানান, পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় পাঠ্যবইয়ে কিছু কিছু ভুল থেকে যাচ্ছে। এছাড়া প্রতিটি বই প্রেসে দেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের দেয়া হয়। তারা চূড়ান্ত করার পরই বই প্রেসে দেয়া হয়। কিন্তু দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের চোখে ভুলগুলো ধরা না পড়লে এনসিটিবির কিছু করার থাকে না। তাই এসব ভুল নিয়ে পরবর্তীতে আবার কাজ করতে হয়।

 

চলতি বছরের নতুন বইয়ের কয়েকটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শুধু অষ্টম ও নবম-দশম শ্রেণির বইয়ে ৩০টির বেশি ভুল রয়েছে। নবম-দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ বইতে লেখা হয়েছে, ‘১২ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের নিকট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন।’

 

বইটির ২০০ নম্বর পৃষ্ঠায় ছাপানো এ তথ্যে রয়েছে ভুল। সঠিক তথ্য হলো, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে শপথ পড়িয়েছেন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। একই বইয়ের ১৮১ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘২৬শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ জুড়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নির্যাতন, গণহত্যা আর ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠে।’ সঠিক তথ্য হলো, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নির্যাতন, গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা শুরু হয় ২৫শে মার্চ কালরাতে।

 

এই বইয়েই সংবিধানের আলোচনায় বলা হয়েছে, ‘পঞ্চম ভাগে জাতীয় সংসদ’। সঠিক তথ্য ‘পঞ্চম ভাগে আইনসভা’। একই শ্রেণির আরেক বইয়ে ‘পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্প, পিলখানা ইপিআর ক্যাম্প ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আক্রমণ চালায় ও নৃশংসভাবে গণহত্যা ঘটায়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বইয়ের ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় এমন তথ্য দেয়া হয়। যদিও রাজারবাগ ছিল পুলিশ লাইন্স। আর পিলখানায় ছিল ইপিআর সদর দপ্তর।

 

অষ্টম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ বইয়েও রয়েছে বেশ অসঙ্গতি। এ বইয়ে দেশের ভয়াবহ বন্যার সালগুলো উল্লেখ থাকলেও ১৯৮৭, ২০০০, ২০০৭ ও ২০১৭ সালের বন্যার খবর নেই। এছাড়া বিভিন্ন শ্রেণির বইয়ে অনেক ভুল রয়েছে। বানান ও যতি চিহ্নের ভুল রয়েছে বেশিরভাগ বইয়ে। আছে ব্যাকরণগত ভুলও। পাঠ্যবইয়ে এসব ভুল নিয়ে সমালোচনা চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ প্রকাশ্যেই অনেকে সমালোচনা করছেন এসব ভুলের।

 

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ক্ষোভ জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর মো. মিজানুর রহমান। তিনি লেখেন, ‘বখতিয়ার খলজী অসংখ্য বিহার ও লাইব্রেরি ধ্বংস করেছেন’ এরকম অনেক অনৈতিহাসিক, অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েই লেখা হয়েছে এবারের স্কুলের পাঠ্যবই। কোনো নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সোর্সই এ ধরনের বক্তব্যের সত্যতা প্রতিপাদন করে না। মনে হয়েছে, ইতিহাস নয় বরং লেখকদের কারো কারো নিজস্ব বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে বইয়ের পাতায় পাতায়।

 

তিনি আরও লেখেন, পাক-ভারত-বাংলাদেশ এক সময় ছিল বৌদ্ধ অধ্যুষিত। সেই বৌদ্ধরা কীভাবে এদেশ থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হয়ে গেল তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে তবে তার কোনোটাতেই বখতিয়ার খলজীকে অনেকগুলো বিহার ও লাইব্রেরি ধ্বংসের জন্য দায়ী করা হয় নাই। এনসিটিবিটি কীসের উপর ভিত্তি করে লেখক আর কন্টেন্ট নির্ধারণ করে বুঝতে পারলাম না।

 

পাঠ্যবইয়ে ভুলের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড. মো. আব্দুস সালাম বলেন, “বিনামূল্যে বই একটি সাহসী সিদ্ধান্ত। পৃথিবীর আর কোথায়ও এমন আছে কিনা, আমার মনে হয় না। সরকারের পরিকল্পনা চমৎকার। কিন্তু পাঠ্যবইয়ে ভুল তথ্যের বিষয়টি দুঃখজনক। সংশ্লিষ্টদের আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল। পরবর্তীতে হয়তো সংশোধন হবে, কিন্তু যে ভুল হয়ে গেছে, সেটির তো একটি প্রভাব রয়েছে।”

 

পাঠ্যবইয়ে ভুলের বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম বলেন, “আমরা ভুলগুলো দেখছি। কারেকশন করছি। পাঠ্যবইয়ে ভুলের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘এবার ষষ্ঠ, সপ্তম ও প্রথম শ্রেণিতে যে বইগুলো শিক্ষার্থীদের হাতে উঠেছে, সেগুলোতে ভুল থাকতে পারে। কারণ বইগুলো নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে। বইগুলোতে যেসব ভুল পাওয়া যাবে সেগুলো আগামী বছরগুলোতে সংস্কার করবো।’ ভুলের তথ্য পাওয়া গেলে তা জানাতে বলেছেন তিনি।”


শেয়ার করুন

আরও খবর

Sponsered content