প্রতিনিধি ১৪ মে ২০২৩ , ১২:৩৫:০৩
১৯৭২ সালের ঈদুল আযহা এসেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ঈদ হয়ে। মুক্তিযুদ্ধকালীন কেবল একটি ঈদই উদযাপিত হয়েছিল। যা ছিল ঈদুল ফিতর। আর তার পরবর্তী ঈদুল আযহা এসেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে, বিজয়ের পূর্ণ আনন্দ নিয়ে। ১৯৭২ সালে ঈদুল আযহা উদযাপিত হয়েছিল ২৭ জানুয়ারি। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার।
বিজয়ের মাত্র ১ মাস ১০ দিন পরেই এসেছিল ঈদ। সেই ঈদ একদিকে যেমন ছিল স্বস্তির, আনন্দের, ঠিক তেমনি শহীদ পরিবার আর স্বজনদের মাঝে ছিল বেদনার। এই প্রথম স্বজনকে ছাড়া ঈদের আনন্দ ম্রিয়মাণ ঠেকেছিল তাদের কাছে। অন্যদিকে, অনেকের স্বজনরা তখনো নিখোঁজ। কারণ বিজয় এসেছে মাত্র ১ মাস ১০ দিন পূর্বেই। অগণিত পরিবারের সদস্যরা, স্বজনরা জানেন না তাদের পরিবারের সদস্যরা আদৌ ফিরে আসবেন কিনা। নাকি চিরতরে চলে গেছেন জীবন নদীর ওপারে। বধ্যভূমির পর বধ্যভূমি খুঁজে বেড়াচ্ছেন নিখোঁজ মানুষের স্বজনরা। দুচোখে অসীম প্রতীক্ষা, যদি ফিরে আসে স্বজন। যদি নিয়তির অবরুদ্ধ পথ ভেঙে এসে হাজির হয় চিরচেনা প্রাণের বন্ধু, স্বজন, পরিবারের সদস্যরা। এই যে অপেক্ষা আর চিরন্তন পরীক্ষা, দুয়ে মিলে আনন্দ আর বিষাদে রাঙা ছিল সেবারের ঈদ। তবে যাদের পরিবারের স্বজনরা যুদ্ধ শেষে ফিরে এসেছেন সুস্থভাবে, তাদের পরিবারে আনন্দের বাঁধ ভেঙেছিল।
ঈদের আগের দিন ২৬ জানুয়ারি ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পৃথক বাণীতে দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানান। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বাণীতে বলেন, ‘ঈদুল আযহা আমাদের আত্মত্যাগের শিক্ষা দেয়। বাংলাদেশের সাহসী মানুষ দেশকে স্বাধীন করার জন্য সম্পদ ও রক্ত দিয়ে চরম আত্মত্যাগ স্বীকার করেছেন।’
রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ঈদ উপলক্ষে দেওয়া তার বাণীতে বলেন, ‘আজিকার ঈদ উৎসবের নয়, বেদনার ঈদ। সমগ্র বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেক পরিবারই প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যথায় শোকাভিভূত। ঈদের দিন সেই ব্যথা আরও গভীরভাবে পরিব্যাপ্ত। তাই এবারকার ঈদ অত্যন্ত শান্ত এবং ভাবগম্ভীর পরিবেশে ধর্মীয় অনুষ্ঠানরূপে পালন করা উচিত।’
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঈদুল আযহার মাত্র আড়াই সপ্তাহ আগেই স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ঈদের দিন ঈদের নামাজ আদায় করেন ধানমন্ডি ক্লাব ময়দানে। বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার আশায় অনেকেই হাজির হয়েছিলেন ঈদের জামাতে। ঈদের নামাজের পর পরিবারের স্বজন, নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কোলাকুলি করে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন বঙ্গবন্ধু। ঈদের দিন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে তার বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন দেশ-বিদেশের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। আগত অতিথিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন বঙ্গবন্ধু।
এদিন ঢাকায় ঈদের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছিল আউটার স্টেডিয়ামে। আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ঈদ জামাতে ইমামতি করেন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। উক্ত ঈদের জামাতে রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীসহ মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরা, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল এম এ জি ওসমানীসহ গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। ঈদের জামায়াতের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অটুট রাখার জন্য মোনাজাতে বিশেষ দোয়া করা হয়। একইসঙ্গে মোনাজাতে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয়। ঈদের নামাজ শেষে রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ঈদের জামাতে শরীক হওয়া মুসল্লিদের সঙ্গে কোলাকুলি করে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। ঈদ উপলক্ষে বঙ্গভবনের প্রধান ফটক জনসাধারণের জন্য এদিন উন্মুক্ত ছিল। রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বঙ্গভবনে আগত বহু সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছিলেন।
২২ জানুয়ারি তথা ঈদের পাঁচদিন আগে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ভাসানী ফিরে আসার পাঁচ দিন পরেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঈদুল আযহা। স্বভাবতই যা তার ভক্তদের জন্য ছিল ভীষণ উচ্ছ্বাসের।
মওলানা ভাসানী স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ঈদ করেছিলেন টাঙ্গাইলের সন্তোষে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, মওলানা ভাসানী মুক্তিযুদ্ধকালীন ঈদুল ফিতর উদযাপন করেছিলেন ভারতের দিল্লিতে। এবারের ঈদ তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে তার বাড়িতেই পালন করলেন। সন্তোষে মওলানা ভাসানীর বাড়িতে সেই ঈদ উদযাপন প্রকাশিত হয়েছিল সাপ্তাহিক ‘হক কথা’ পত্রিকায়।
হক কথা পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাটি ছিল এমন, ‘১৯৭২ সালের ঈদুল আজহা অনেক নতুনত্ব লইয়া আসিল। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ঈদ। মাত্র কয় দিন হইল হুজুর ভারত হইতে ফিরিয়া আসিয়াছেন। ঈদুল ফিতরে তিনি দিল্লীর শাহী মসজিদে সশস্ত্র রক্ষীবেষ্টিত অবস্থায় নামাজ আদায় করিয়াছেন। ঈদুল আজহায় আবার স্মৃতিময় সন্তোষে স্ত্রী, মেয়ে, নাত-নাতনী লইয়া ঈদ করিলেন। এইবার অনেক ব্যতিক্রম। হুজুরের মুরিদদের হালত খুবই খারাপ। অতএব হুজুরেরও। সবই তো পুড়িয়া গিয়াছে। ঘরে খাবার বাসনটি পর্যন্ত নাই। রাতের হারিকেন নাই। বিছানাপত্তর নাই। একটা চৌকিও নাই। খড় আর কাঁথা বিছাইয়া ভাসানচরের মাওলানা লাখো ভক্তের হুজুর স্ত্রী, মেয়ে, নাত-নাতনী লইয়া রাত গুজরান করিতেছেন। যাহারা ব্যক্তিগতভাবে হুজুরের জীবনযাত্রা দেখেন নাই, তাহাদের জন্য ইহা বিশ্বাস করিতে কিংবা মানিয়া লইতে কষ্টকর ব্যাপার হইবে। টাঙ্গাইলের তদানীন্তন সিভিল সার্জন ডাক্তার কফিল উদ্দিনের তাগিদে হুজুরের জন্য একটি চৌকির ব্যবস্থা করা হইয়াছিল। অভাবনীয় অনাড়ম্বরে হুজুরের বাড়িতে এইবার ঈদুল আজহা গেল।’
ঈদ পরবর্তী কর্মদিবস ২৯ জানুয়ারি শনিবার দৈনিক বাংলা প্রথম পৃষ্ঠায় ঈদ উদযাপনের এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘আনন্দের পাশাপাশি মূর্ত হয়েছিল শোক আর বেদনার প্রতিচ্ছবি’।
এই প্রতিবেদনে এমনটাই লেখা ছিল, ‘গত বৃহস্পতিবার সারা দেশে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে ঈদ উল আযহা উদযাপিত হয়েছে। এবার ঈদের আনন্দের পাশাপাশি মূর্ত হয়ে উঠেছে শোক আর বেদনার প্রতিচ্ছবি। স্বজন হারানোর ব্যথা বদনায় শোকাতুর বাংলার মানুষ এবার ঈদ পালন করেছে। শত শোকাচ্ছন্ন মুহূর্তের মধ্যেও ঈদের উৎসব এসেছে এক অনির্বাণ জ্যোতি নিয়ে। বাংলার ঘরে ঘরে ঈদ শত দুঃখ বেদনা আর শোকের মাঝেও প্রদীপ্ত।’
ঈদ উপলক্ষে দৈনিক বাংলায় ‘কোরবানী: আজকের দিনের তাৎপর্য’ শিরোনামে আবদুল আউয়ালের লিখিত একটি কলাম প্রকাশিত হয়েছিল। ‘আত্মত্যাগই কোরবানির মর্ম কথা। প্রতিটি অনুশাসন ও বিধানে তারই প্রতিফলন। খোদা সামর্থ্যবান মুসলমানদের ওপর কোরবানি করার যে বিধান দিয়েছেন, তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হচ্ছে ত্যাগ, নিছক পশু বধ আর মাংস ভোজন নয়। ইসলামের এই বিধানের ঐতিহাসিক কাহিনীতেও ত্যাগের আদর্শ কার্যতই দেখতে পাওয়া যায়।’
২৯ জানুয়ারি ১৯৭১ সালে দৈনিক পূর্বদেশ প্রতিবেদন করেছিল এমনই, ‘ঢাকাসহ বাংলাদেশের সর্বত্র গত বৃহস্পতিবার যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে অনাড়ম্বরভাবে ঈদুল আজহা উদযাপিত হয়েছে। মুক্ত মাতৃভূমিতে এটাই প্রথম ঈদ উৎযাপন। ঈদুল আজহা উপলক্ষে ঢাকার আউটার স্টেডিয়াম, বায়তুল মোকাররম মসজিদ, গেন্ডারিয়া, ইস্ট অ্যান্ড মাঠ, ধানমন্ডি ক্লাব ময়দান, আর্মানিটোলা, আজিমপুর কমিউনিটি সেন্টারসহ নানা ময়দান ও মসজিদে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে।’
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ঈদে তথা ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর ঈদুল ফিতরের আগের দিন সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’ পত্রিকায় যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যে বানী দিয়েছিলেন তা ছিল এমন, ‘আমাদের দেশে এবার ঈদ এসেছে অত্যন্ত মর্মান্তিক পরিবেশে। দখলীকৃত এলাকায় শত্রুসৈন্যের তাণ্ডব চলছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে বিচ্যুত হয়ে শরণার্থী হয়েছেন। মুক্ত এলাকায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি চলছে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য, রক্তের বিনিময়ে মানুষ মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম করছে। এবার ঈদে আনন্দ মুছে গেছে আমাদের জীবন থেকে, আছে শুধু স্বজন হারানোর শোক, দুর্জয় সংগ্রামের প্রতিজ্ঞা ও আত্মত্যাগের প্রবল সংকল্প। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং আমার নিজের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জনসাধারণকে ঈদ উপলক্ষে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ঈদের যে আনন্দ আজ আমরা হারিয়েছি, তা আমাদের জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে সেদিনই, যেদিন আমরা দেশকে সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত করব।’
ঠিক সে বাণীর প্রতিফলন হয়েছিল আমাদের জাতীয় জীবনে। আমরা বিজয় অর্জনের পাশাপাশি দেশকে শত্রুমুক্ত করেছিলাম। আর তাই মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ঈদ ছিল মুক্তির আনন্দের সঙ্গে যুক্ত উৎসবের পূর্ণ রেশ। মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানোর বেদনার তাজা স্মৃতির মাঝে একটুখানি উপশম ছিল এই ঈদ। যদিও সেই উপশম আদৌ সম্ভব না। কিন্তু তবুও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ঈদ এসেছিল মুক্তি আর উৎসবের বার্তা নিয়ে।
সূত্র:
দৈনিক বাংলা, ২৯ জানুয়ারি ১৯৭২
দৈনিক বাংলা, ২৬ জানুয়ারি ১৯৭২
দৈনিক পূর্বদেশ, ২৯ জানুয়ারি ১৯৭২
আমার ভালোবাসা: মওলানা ভাসানী/সৈয়দ ইরফানুল বারী
সাপ্তাহিক জয় বাংলা, ২৮তম সংখ্যা, ১৯ নভেম্বর ১৯৭১