প্রতিনিধি ১৮ জুন ২০২৩ , ১০:৩৪:২০
ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে আইএমএফের পরামর্শে সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য ‘সংকুলানমুখী ও আঁটসাঁট’ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অন্যদিকে নতুন মুদ্রানীতি অনুযায়ী ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল
ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম-৬) ফর্মুলা মেনে চলবে বাংলাদেশ। এর ফলে দেশের রিজার্ভ দাঁড়াবে ২৩.৮৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে। আর এটি পুরোপুরি মানতে গেলে নিট রিজার্ভ নেমে যাবে ২০ বিলিয়নের ঘরে।
গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১ম ষাণ¥াসিক এর জন্য (জুলাই-ডিসেম্বর-২০২৩) নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়। পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে নতুন মুদ্রানীতি তুলে ধরেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান।
জানা গেছে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। বাংলাদেশ ব্যাংক এতদিন মোট রিজার্ভের যে হিসাব প্রকাশ করে আসছিল তা নিয়ে খোদ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রশ্ন তুলেছে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবের মধ্যে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগকে অন্তর্ভুক্ত দেখানো হয়। মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ব্যালান্স অব পেমেন্ট ৬ বা বিপিএম৬-এর ফর্মুলায় যাবো। আইএমএফ সদস্যভুক্ত দেশগুলো বিপিএম৬-এর ফর্মুলা কার্যকর করেছে, আমরাও সেটা করবো। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবও থাকবে।
তবে আইএমএফের ৪.৭০ বিলিয়ন ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল, নিট রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করা। এক্ষেত্রে মানতে হবে বিপিএম৬ ফর্মুলা। এটি পুরোপুরি মানতে গেলে নিট রিজার্ভ নেমে যাবে ২০ বিলিয়নের ঘরে। কারণ, দেশের প্রকাশ করা রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ ও রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) ছাড়াও এক বছরের বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের সমপরিমাণ অর্থ বাদ দিলে পাওয়া যাবে নিট রিজার্ভ।
বর্তমানে রিজার্ভ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলার রয়েছে ইডিএফ ও বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ। এগুলোসহ মোট রিজার্ভ এখন ২৯.৮৩ বিলিয়ন ডলার। বিনিয়োগ করা ৬ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে নিট রিজার্ভ দাঁড়াবে ২৩.৮৩ বিলিয়ন ডলার।
গভর্নর বলেন, আমরা রিজার্ভ থেকে যেসব বিনিয়োগ করেছি সেগুলো ঝুঁকিমুক্ত। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমাদের সব ঋণের গ্যারান্টার রয়েছে। সব টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক ফেরত পাবে। শ্রীলঙ্কার লোনও আমরা ফেরত পেতে পারি তাদের স্থানীয় মুদ্রায় সমন্বয়ের মাধ্যমে।
প্রশ্নোত্তর পর্বে গভর্নর বলেন, এবারের মুদ্রানীতি ‘কন্ট্রাকশনারি ও টাইট’ ভঙ্গির। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনা পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব ‘দুই পদ্ধতিতেই’ করবে। অর্থাৎ, আগে যে পদ্ধতিতে করা হতো, সেভাবেও করা হবে, আবার বিপিএম৬ পদ্ধতিতেও করা হবে। তবে আমরা বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুযায়ী, প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য হিসাব করলেও তা প্রকাশ করবো না। পৃথিবীর কোনো দেশ তা প্রকাশ করে না। আইএমএফের এ বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই প্রকাশে।
জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৪৩ শতাংশ, গত মুদ্রানীতিতে যা ছিল ৩৭.৭ শতাংশ। আর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১০.৯ শতাংশ, গতবার ধরা হয়েছিল ১৪.১ শতাংশ। সবমিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৬.৯ শতাংশ, গতবার যা ধরা হয়েছিল ১৬.৯ শতাংশ। মুদ্রানীতির প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ৩৭.৭ শতাংশ ধরা হলেও মে মাস শেষে অর্জন হয়েছে ৪৩.৩ শতাংশ। আর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৪.১ শতাংশ, হয়েছে ১১.১ শতাংশ। সবমিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৮.৫ শতাংশ, আর গত মে পর্যন্ত হয়েছে ১৬.৭ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিস দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দেয়ার প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, আমার মতে মুডিসের এই কাজটি ভূ-রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আমি মনে করি আমাদের অর্থনীতি ক্রমেই সবল হচ্ছে। প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমতে পারে। কিন্তু আগের চেয়ে দুর্বল হয়নি।
ব্যাংক ঋণের বেঁধে দেয়া ৯ শতাংশ সুদহার তুলে দেয়া হয়েছে। এই সুদের হার মোটামুটি বাজারভিত্তিক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। নতুন মুদ্রানীতিতে বলা হয়, আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরু থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হবে। ইতিমধ্যে এ সুদহার মোটামুটি বাজারভিত্তিক করা হয়েছে।
ঋণের সর্বোচ্চসীমা নিয়ে এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ৯ শতাংশ সুদের সীমা উঠানো হয়নি বরং এক শতাংশ বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। আইএমএফের শর্ত ছিল ব্যাংক ঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করা। সেক্ষেত্রে আইএমএফের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করতে হবে। যে এটা বাজারভিত্তিক হয় কিনা। কেননা তাদের কাছ থেকে ৪.৭০ বিলিয়ন ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি আসবে আগামীতে।
নতুন সুদহার ব্যবস্থা হলো ‘স্মার্ট’ তথা শর্ট টার্ম মুভিং এভারেজ রেট। ১৮২ দিন মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বিলের ৬ মাসের গড় সুদের সঙ্গে আপাতত সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ করিডোর বা সীমা দেয়া থাকবে। বর্তমানে ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ৭ শতাংশের নিচে রয়েছে। এর মানে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সুদহার হবে ১০.১০ শতাংশের আশপাশে।
নতুন মুদ্রানীতিতে নীতি হার হিসাবে বিবেচিত রেপো সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬.৫০ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো জরুরি প্রয়োজনে অর্থ নিলে গুনতে হবে অতিরিক্ত সুদ।
পাশাপাশি রিভার্স রেপো ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৪.২৫ শতাংশ থেকে ৪.৫০ শতাংশ করা হয়েছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টাকা রাখলে ব্যাংকগুলো আগের চেয়ে বেশি সুদ পাবে। এ ছাড়া ডিসকাউন্ট রেটে ব্যাংকগুলোর কাছে আর কোনো ডলার বিক্রি না করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে নতুন মুদ্রানীতিতে।