প্রতিনিধি ৫ জুন ২০২৩ , ৯:৫৩:৫৯
ঢাকার বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের সাম্প্রতিক মানবাধিকার চাপকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে গত ২৪শে মে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ঘোষণা। সেটি হলো নির্বাচনে কারচুপির সঙ্গে জড়িত বলে মনে করলে দেশটি যে কারও ভিসা বাতিল করে দেবে। রাজনৈতিক সহিংসতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্বাচনে কারচুপির জন্য বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে। কিছু পর্যবেক্ষক এই যুক্তি দেখান যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা চলাকালে ঢাকায় বেইজিংয়ের প্রভাব হ্রাস করার জন্য হাসিনাকে চাপ দেয়ার উদ্দেশ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থান। আওয়ামী লীগের সঙ্গে দিল্লির যেহেতু দীর্ঘ কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে, সে কারণে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের পদক্ষেপগুলো শেষ পর্যন্ত অসাবধানতাবশত, ভারতের জন্য জটিল এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। কোয়াডে তার জোট অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনার বিরোধিতা করে, অন্যদিকে তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীন শেখ হাসিনাকে সমর্থন করে- ভারতকে এই বাস্তবতার মধ্যেই কৌশল অবলম্বন করতে হবে।
ভারতীয় নিউজ ওয়েবসাইট স্ক্রল.ইন-এর এক প্রতিবেদনে এসব মন্তব্য করে তুলে ধরা হয়েছে ওয়াশিংটনের অবস্থান:
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি বর্তমান এবং সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকারপন্থি ও বিরোধী দলের সদস্য, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্যদের লক্ষ্য করে নেয়া হয়েছে যদি তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে মনে করা হয়। পাশাপাশি তাদের পরিবারের সদস্যদের ভিসাও প্রত্যাখ্যান করা হতে পারে।
যদিও বাংলাদেশ সরকার দাবি করছে যে, এই ভিসা নীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই, কিন্তু পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এটি সেইসব কর্মকর্তাদের ক্ষতি করবে যারা তাদের সন্তানদের যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করার জন্য পাঠাতে চায়। দক্ষিণ এশিয়ার অভিজাতরা সাধারণত তাদের সন্তানদের সেখানেই পাঠান।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে,শেখ হাসিনা সরকারকে মানবাধিকারের বিষয়ে চাপ দিতে এবং নির্বাচনে কারচুপির বিরুদ্ধে সতর্ক করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এরকম বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে, ওয়াশিংটন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। র্যাবের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ হয়ে জোরপূর্বক গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে।
এক বছর পর, অবাক করে দিয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, হাসিনার শাসনামলে কথিত জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাউন্সেলর ডেরেক শোলে ঢাকাকে এই বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ আমেরিকান সহযোগিতাকে সীমিত করবে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য তিনি হাসিনাকে হাল্কা চাপ দিয়েছিলেন।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ-এর এসোসিয়েট প্রফেসর অভিনাশ পালিওয়ালের মতো পর্যবেক্ষকরা বলছেন যে, বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগই ওয়াশিংটন-ঢাকা সংঘর্ষের ক্ষেত্রে ‘সবচেয়ে প্রভাবশালী কারণ’।
পালিওয়াল বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যেদিকে যাচ্ছে সে সম্পর্কে তারা চুপচাপ।’
বৈশ্বিক অবকাঠামো উন্নয়ন কৌশল ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) সহ বিভিন্নভাবে চীন বাংলাদেশে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। দেশটি বাংলাদেশের ৯০% নতুন জ্বালানি প্রকল্পগুলোতে অর্থায়ন করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকাভিত্তিক একজন প্রাজ্ঞ সাংবাদিক বলেন, চীন বিষয়ে ওয়াশিংটন হাসিনাকে বিশ্বাস করে না। ওয়াশিংটনের গৃহীত ব্যবস্থা তার চীন নিয়ন্ত্রণ নীতিরই অংশ।
যাই হোক, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, ওয়াশিংটনের দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশকে তার মূল্যবোধভিত্তিক বৈদেশিক নীতির একটি উদাহরণ হিসেবে তৈরি করা, যেই নীতি গণতন্ত্রের প্রচারের উপর জোর দেয়। কুগেলম্যান বলেন, ‘এর মানে এই নয় যে [ওয়াশিংটন] ঢাকার বিরুদ্ধে সামগ্রিকভাবে সংঘর্ষের অবস্থান নিয়েছে। এটি একটি নির্বাচনী নীতি, তবে এটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দৃঢ়ভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। সুতরাং, এর অর্থ হলো [বাইডেন] প্রশাসন আওয়ামী লীগের গণতন্ত্রবিরোধী নীতিকে নিজের লক্ষ্য বানিয়েছে।’
বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্যাপকভাবে লেখালেখি করা বৃটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান একইভাবে বলছেন যে, ‘স্বৈরতন্ত্রের উপরে গণতন্ত্র সম্পর্কে (বাইডেন প্রশাসনের) একটি দৃঢ়নীতি এবং অবস্থান’ রয়েছে। ‘আমি মনে করি না এটি বাংলাদেশে চীনা প্রভাবের কারণে’Ñ বার্গম্যান বলছিলেন।
ভারতের জন্য এটা কী কঠিন পরিস্থিতি? এই প্রশ্ন রেখে স্ক্রল.ইন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘ওয়াশিংটনের এই নীতি ভারতকে জটিল পরিস্থিতিতে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত অন্যান্য ক্ষেত্রে অংশীদার হলেও, দিল্লি হাসিনাকে সমর্থন করে বলে বাংলাদেশে দুই দেশের লক্ষ্য সংঘর্ষে পরিণত হবে বলে মনে হচ্ছে।
অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন স্টাডিজের ভাইস প্রেসিডেন্ট হর্ষ ভি পান্ত বলেন, ‘ভারত আসলেই শেখ হাসিনার সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি করেছে। ওই সম্পর্কগুলো তার মেয়াদে অনেক কিছু অর্জন করেছে এবং তাদের সম্পর্কের মাঝে এক ধরনের স্থিতিশীলতা রয়েছে, যা ভারত, বাংলাদেশ এবং এই অঞ্চলের জন্য শুভ লক্ষণ।’
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এর আগে, বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সরকারের সময় হিমশিম খেয়েছে। দলটিকে ব্যাপকভাবে ভারতবিরোধী অবস্থানে দেখা যায়। কিন্তু ঢাকায় হাসিনার নেতৃত্বে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গত ১৫ বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে স্থিতিশীলের পাশাপাশি গভীরও হয়েছে।
এতে উভয় দেশের নানান দ্বিপক্ষীয় সমস্যা যেমন দীর্ঘস্থায়ী স্থল সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে, বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আঞ্চলিক সংযোগে সহযোগিতা হয়েছে, যা কিনা দিল্লির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ থেকে সক্রিয় উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহীদেরও দমন করেছে হাসিনার সরকার।
পান্ত এই যুক্তি দেখান যে, ওয়াশিংটন যেভাবে পারে, সেভাবে দিল্লি হাসিনার সরকারের বিরোধিতা করতে চাইবে না। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ভারত যেভাবেই সম্ভব শেখ হাসিনাকে সমর্থন করা অব্যাহত রাখবে। কারণ বিকল্পের প্রতি ভারতের উপলব্ধিও সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি না, এই ঢাকা-ওয়াশিংটন ঝামেলার অংশ হতে চাইবে ভারত।’
একইভাবে, পালিওয়াল বলেন যে, যদিও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বের কেউ কেউ বুঝতে পারেন যে, তাদের ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক দরকার, কিন্তু দিল্লি এই বিশ্বাস করে না যে, কয়েক বছর ধরে শেখ হাসিনা যা দিয়েছেন, ওই দলটি ততটা দিতে পারবে।তবে দলটি নির্বাচনে জয়ী হলে ভারতকে তার সঙ্গে ‘ডিল’ করতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই প্রাজ্ঞ সাংবাদিকও বলেন, ‘ভারত বিএনপিকে চরমপন্থি বলে মনে করে।’
‘চুপচাপ থাকাটাই ভালো’
এসব কিছু মিলিয়ে কুগেলম্যান বলেন, হাসিনার প্রতি ওয়াশিংটনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভারতের তেমন কিছু করার নেই। অবশ্যই, দিল্লির মনের ইচ্ছা সম্ভবত আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় ফিরে আসুক। কিন্তু তার জন্য সেরা বাজি হলো চুপচাপ থাকা। মোদি আর বিজেপি হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হতে পারে, কিন্তু ভারতের প্রতি বাংলাদেশের জনসাধারণের অনুভূতি আরও বেশি জটিল।
দিল্লির নিরবতা থাকার মধ্যদিয়ে দেশটি ঢাকা থেকে আরও বেশি আস্থা এবং শুভেচ্ছা অর্জন করে। কিন্তু সেটি তাকে ওয়াশিংটনের অবস্থানের বিপরীতে রাখে’, তিনি যোগ করেন।
সবদিকে খেলছে চীন?
প্রাজ্ঞ ওই সাংবাদিক বলেন, হাসিনাকে ক্ষমতায় দেখতে বেইজিংও পছন্দ করে। ‘[চীন] বাংলাদেশে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। বিএনপি এখন যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি এবং চীনা অবস্থানের নিন্দা করেছে।’ এর মানে এই ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ ভারত ও চীন একই অবস্থানে। বাংলাদেশই একমাত্র জায়গা যেখানে চীন এবং ভারতের স্বার্থ শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকা একই, বলছিলেন ওই সাংবাদিক।
বার্গম্যান বলেন, চীন হাসিনাকে পছন্দ করতে পারে এই কারণে যে বেইজিং তার সঙ্গে এক দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করেছে।
কুগেলম্যান বলেন, বেইজিং নিজের সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক যে কাউকে সমর্থন করবে। হাসিনার সঙ্গে চীন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে এই কারণে যে, তার ক্ষমতায় থাকার সময় বাংলাদেশে চীনের পদচিহ্ন অনেক গভীর হয়েছে। কিন্তু যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে, আমি নিশ্চিত যে, দলটি চীনাদের সম্পৃক্ততাকে স্বাগত জানাবে এবং বেইজিং বিএনপি’র সরকার প্রধানের সঙ্গেও কাজ করবে।’
পালিওয়াল এবং পান্ত এ বিষয়ে একমত যে, চীন সবদিক দিয়েই খেলছে। পালিওয়াল বলেন, ‘এটি হাসিনার সঙ্গে মিষ্টি আলাপ করছে এবং তাকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঠেলে দিচ্ছে। তবে সে বিএনপি’র সঙ্গেও কথা বলছে।’