প্রতিনিধি ৯ জুন ২০২৩ , ১০:২৯:২৯
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলী ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ২০১৪ সাল কিংবা ২০১৮ সালের ‘নির্বাচনী মরীচিকা’ পুনরাবৃত্তি করার সুযোগ আর আওয়ামী লীগের কাছে নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন যে বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হবে। এর মানে এখন থেকে ৬ মাস পর ৩০০টি সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে আমাদের পূর্বানুমান করা উচিত। দেশটির রাজনীতির যে ধরন সে অনুযায়ী, এমন একটি বৃহৎ আকারের সাধারণ নির্বাচনে সাধারণত ব্যাপক প্রস্তুতি, প্রচারণা এবং অন্যান্য আনুষাঙ্গিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। তবে এটা অদ্ভূত যে রাজধানী ঢাকার বাসিন্দারাও এমন কোনো ইঙ্গিত দেখেননি যে তাদের দিগন্তে নির্বাচন উঁকি মারছে। ২০২৪ সালের সম্ভাব্য নির্বাচনী ফলাফলের ভবিষ্যদ্বাণীর চেষ্টা করে মূলধারার বাংলাদেশি গণমাধ্যমে টুকটাক আলোচনা রয়েছে।
সাধারণ নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশের জনগণের উৎসাহে ভাটা পড়ার বিষয়টি দেশটির সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ শাসনের পতন বাংলাদেশকে একটি প্রতিযোগিতামূলক বেসামরিক শাসনের যুগে নিয়ে গিয়েছিল, যেখানে শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত পালাক্রমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট শাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে এক ধরনের নির্দলীয় ব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগের দাবি অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী পাস করে। এই বিধান অনুযায়ী নির্বাচনের ৯০ দিন আগে সংসদ এবং মন্ত্রিসভা ভেঙে দিতে হবে এবং একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সমর্থনপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের কাছে হেরে যায়, যার মাধ্যমে শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন।
বিজ্ঞাপন
২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বিএনপির কাছে পরাজিত হলে খালেদা জিয়া দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন।
উল্লেখ্য, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে কোনো ক্ষমতাসীন সরকারই পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেনি।
বিএনপি সরকার নিজের সুবিধার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। তাদের উদ্যোগের মধ্যে ছিল- প্রধান বিচারপতি মোদাচ্ছির হোসেনের পরিবর্তে সাবেক প্রধান বিচারপতি কে.এম. হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য প্রধান বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ৬৭ বছর করা। কে.এম. হাসান প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালে, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেকে এই পদে নিযুক্ত করে একইসঙ্গে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান বনে যান।
চলমান সাংবিধানিক সংকট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্তের কারণে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হয়। এসব মিলিয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব চালিয়ে গেলেও প্রধান উপদেষ্টার পদ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অন্তর্বর্তী টেকনোক্র্যাটিক সরকার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় যার প্রধান উপদেষ্টা হন ড. ফখরুদ্দীন আহমদ, সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন আহমেদ তাতে সমর্থন দেন। ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসন ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি ক্ষমতা দখল করায় এটিকে নেতিবাচক অর্থে ১/১১ সরকার বলা হয়ে থাকে।
২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচন ওই ১/১১ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল যাতে আওয়ামী লীগ বড় জয় পেয়েছিল। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এটিই ছিল বাংলাদেশের সর্বশেষ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন।
আওয়ামী লীগ সংসদে ‘সুপার মেজরিটি’ ছিল। বাংলাদেশের ভোটারদের মধ্যে যেহেতু ক্ষমতাসীন সরকারবিরোধী’ বড় প্রবণতা রয়েছে, তাই এতে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না যখন তারা সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়।
১৯৯৬ সালের জুনের সাধারণ নির্বাচনের পর ২০১৪ সালের নির্বাচনই ছিল প্রথম নির্বাচন যা নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা প্রায় অসম্ভব এটা বুঝতে পেরে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেয়। ওই নির্বাচন বাতিল করা হবে অথবা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অধীনে নতুন নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগকে চাপ দেয়া হবে বলে বিএনপির প্রত্যাশা ছিল। দলটি ভেবেছিল, এতে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের অনুরূপ ফল আসবে, যেটি আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্ররা বয়কট করে বিএনপিকে সংবিধান সংশোধন করতে এবং তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন করতে বাধ্য করেছিল।
এর বিপরীতে, ২০১৪ সালের নির্বাচন আওয়ামী লীগ এবং তার জোটের শরিকদের জন্য ছিল ‘ওয়াকওভার’ যেখানে সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং তার স্ত্রী রওশন এরশাদের প্রতিনিধিত্বকারী জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ ছিল। রওশন এরশাদ তখন থেকেই জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। কিছুটা সময় তার স্বামী এই পদে ছিলেন (জানুয়ারি ২০১৯-জুলাই ২০১৯ বা আমৃত্যু)।
এটি দেশে ব্যাপকভাবে পরিচিত যে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়েছিল। জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেয়ায়, আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের মুখোশ পরাতে পেরেছিল এবং একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার সমালোচনাও এড়াতে পেরেছিল। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যেও জল্পনা-কল্পনা ছিল যে বিএনপি যদি ওই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতো, তবে তারা অন্তত ভালোসংখ্যক আসন পেতো, আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতো না। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর সারা বিশ্বে বাংলাদেশি কূটনীতিকরা এ ধরনের আলোচনা, এমনকি প্রচারণা চালান। এই ধরনের অনুমান এবং জল্পনা আওয়ামী লীগকে ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ দিয়েছে।
বিএনপি এটা ভালো করেই জানতো যে তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসন ছাড়া ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা বর্তমান সরকারকে আরেকটি ওয়াকওভার দেয়ার সমতুল্য। এইভাবে, বিএনপি ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যদিও তাদের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া দুর্নীতির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার কারণে নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত ছিলেন।
এটা এখন যে কোনো যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের বাইরে প্রতিষ্ঠিত (সত্য) যে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি এবং ভোটে অনিয়ম জড়িত ছিল। এভাবে বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দলগুলো প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে কেন তারা ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করেছিল। তাদের যুক্তি এখন প্রমাণিত যে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। বিএনপির ৭ জন সংসদ সদস্য তারপরও শপথ নিয়েছিলেন এবং আইনসভার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেই (সংসদ সদস্য) নির্বাচিত হওয়ার সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছিলেন। তারা সম্প্রতি এই অদ্ভূত ব্যাপারটি স্বীকার করেছেন এবং ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।
বিএনপি বার বার ঘোষণা করেছে যে নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা ২০২৪ সালের নির্বাচন বয়কট করবে, যেমনটি এক দশক আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনেও তারা করেছিল। সুতরাং, এটা এখন স্পষ্ট যে ২০১৮ সালের নির্বাচনী মডেলের পুনরাবৃত্তি এখন খেলার বাইরে।
বাংলাদেশে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান চাপের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালে এসে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনাও কম। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রচারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এবং গত ২৪শে মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন-এর এক বিবৃতির মধ্যদিয়ে। ওই বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্র এক নতুন নীতি ঘোষণা করে যা যুক্তরাষ্ট্রকে ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে বিশ্বাস করা যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তিকে ভিসা প্রদান সীমিত করতে’ সক্ষম করবে। এতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ এখন নির্বাচনে কারচুপির জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে।
এই মুহূর্তে, আওয়ামী লীগের জন্য ২০১৪ বা ২০১৮ সালের নির্বাচনী মরীচিকা কোনোটাই বিকল্প নয়। এর মানে, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে একটি নতুন খেলা হবে। জানুয়ারিতে প্রস্তাবিত নির্বাচন পর্যন্ত ২০২৩ সালের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির আসন্ন ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করা অত্যন্ত আকর্ষণীয় হবে, যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
[দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষক এবং জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষক আনিশ মিশ্রর লেখাটি ৯ই জুন ওয়াশিংটনভিত্তিক ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন তারিক চয়ন]