হঠাৎ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ছুটি বাতিল কারণ হিসেবে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য, চলতি বছর ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন তাই নভেম্বরের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব ধরনের মূল্যায়ন, পরীক্ষা শেষ করতে হবে। তবে গ্রীষ্মকালীন ছুটি শীতের ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করা হবে।
সরকারের এই সিদ্ধান্তের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন শিক্ষক-অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, ছুটি শুরুর একদিন আগে এ সিদ্ধান্তে তাদের পরিকল্পিত রোস্টার এলোমেলো হয়ে গেছে।
ছুটি বাতিলের সিদ্ধান্তে বেশিরভাগ শিক্ষক ক্ষুব্ধ হয়েছে। তবে এ বিষয়ে তারা গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি হননি।
শিক্ষক নেতাদের দাবি, জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষকদের আন্দোলন থামাতেই এ কৌশল নিয়েছে সরকার। যদিও শিক্ষা প্রশাসন থেকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলা হয়েছে, এ ছুটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত আগেই ছিল। তবে সিদ্ধান্তের বিষয়টি আরও আগে জানানো উচিত ছিল।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) প্রফেসর বেলাল হোসাইন বলেন, শিক্ষামন্ত্রী পরিষ্কার করেছেন কেন ছুটি বাতিল করা হয়েছে। এ ছুটি হঠাৎ করে বাতিল করা হয়নি। আগে থেকেই গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিলের সিদ্ধান্ত ছিল। তবে হ্যাঁ আরেকটু আগে জানতে পারলে ভালো হতো।
তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচন এবং করোনাকালীন শিক্ষার ঘাটতি পোষাতে রমযান মাসের ছুটি কমানোর বিষয়ে পরিকল্পনা ছিল। পরে সেই ছুটি না কমিয়ে গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করে শীতের ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করার সিদ্ধান্ত হয়। এখানে শিক্ষকদের আন্দোলন থামানো বা ঠেকানোর কোনো বিষয় নেই।
ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা
ছুটি শুরুর একদিন আগে হঠাৎ গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
ব্র্যাক ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ মর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমার মেয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। সামার ভেকেশনে (গ্রীষ্মকালীন ছুটি) কাটাতে সিঙ্গাপুর যাওয়ার জন্য সব প্রস্তুতি শেষ করেছিলাম। কিন্তু ছুটি বাতিল হওয়ায় যেতে পারেনি। গতকাল (বুধবার) রাতে আমাদের ফ্লাইট ছিল পরে তা বাতিল করেছি। এতে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। আমিও নিজেও ব্যাংক থেকে ছুটি নিয়েছিলাম। এই যে আর্থিক ও মানসিক ক্ষতি হলো তার দায় কে নেবে? এ সিদ্ধান্তটা এক সপ্তাহ আগে জানালে কী হতো?
এ ব্যাপারে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক কেকা রায় চৌধুরী বলেন, ছুটি বাতিল হওয়ায় অনেক ছাত্রী ও তাদের অভিভাবক আমার কাছে কারণ জানতে চেয়েছেন। আমি সরকারের সিদ্ধান্তের কথা তাদের বলেছি। ছুটি বাতিলের বিষয়টি আরেকটু আগে জানতে পারলে ভালো হতো। তবে সরকার যেভাবে সিদ্ধান্ত নেবে আমরা সেটা মানতে বাধ্য।
শুধু ভিকারুননিসা নয়, রাজধানীর বেশিরভাগ স্কুল-কলেজে গ্রীষ্মকালীন ছুটির নোটিশ আরও এক সপ্তাহ আগে দিয়ে দেওয়া হয়। গতকাল সকালে রাজধানীর আইডিয়াল অ্যান্ড কলেজ গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিলের নোটিশ দেওয়া হয়। নোটিশে বলা হয়, ২০ জুলাই থেকে আগামী ৩ আগস্ট পর্যন্ত মোট ১৪ দিন স্কুল বন্ধ থাকবে। এই সময় হিজরি নববর্ষ, গ্রীষ্মকালীন, পবিত্র আশুরার ছুটি থাকবে। এরপর সরকার ছুটি বাতিল করায় সন্ধ্যায় বিজ্ঞপ্তি বাতিল করে কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে নতুন বিজ্ঞপ্তিতে শুধু ২০ জুলাই হিজরি নববর্ষের ছুটির বিষয়টি জানানো হয়।
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদী বলেন, বার্ষিক শিক্ষাপঞ্জীতে ২০ জুলাই থেকে স্কুল ছুটির বিষয়টি উল্লেখ ছিল। তাই আমরা ছুটির নোটিশ দিয়েছিলাম। সরকার বাতিল করেছে তাই আমরাও বাতিল করেছি।
এতে শিক্ষক-অভিভাবক ক্ষুব্ধ কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নো কমেন্ট’।
আইডিয়াল স্কুলের নবম শ্রেণি একজন ছাত্রের বাবা বলেন, ছেলের আবদার অনুযায়ী গ্রীষ্মের ছুটিতে কক্সবাজার যেতে চেয়েছিলাম। সেজন্য বুধবার রাতে বাসের টিকিট, হোটেল বুকিংসহ সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করি। কিন্তু সরকার ছুটি বাতিল করায় শেষ পর্যন্ত যেতে পারলাম না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক বলেন, আমার মেয়ে উদয়ন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। তার চোখের ডাক্তার দেখাতে ভারতে যাওয়ার জন্য বিমানের টিকিট, ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করা ছিল। সব বাতিল করতে হয়েছে। শিক্ষা প্রশাসনের একটি অপরিপক্ব সিদ্ধান্তের কারণে আমাদের আর্থিক ক্ষতি হলো। কমপক্ষে ১৫ দিন আগে এটা জানানো উচিত ছিল।
আন্দোলন থামানোর ‘অপচেষ্টা’ দেখছেন শিক্ষকরা
ছুটি বাতিলকে শিক্ষকদের আন্দোলন থামানোর কৌশল হিসেবে দেখছেন আন্দোলনরত বেসরকারি শিক্ষকরা। শিক্ষকদের দাবি, সরকারের এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্তই ছিল না। থাকলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগেই থেকেই জানানো হতো। আন্দোলন থামানোর জন্য প্রথমে অনুপস্থিত শিক্ষকদের তালিকা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে কাজ না হওয়ায় শেষ মুহূর্তে ছুটি বাতিল করে শিক্ষকদের আন্দোলন থামানোর অপচেষ্টা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক কাওছার আহমেদ বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষকদের যৌক্তিক আন্দোলনকে থামাতে নানা অপকৌশল অবলম্বন করছে। প্রথমে অনুপস্থিত শিক্ষকদের তালিকা করার জন্য চিঠি দেয়। এতে সাড়া না পাওয়ায় এবার গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করেছে।
তার অভিযোগ, গ্রীষ্মকালীনসহ অন্যান্য ছুটি মিলে মোট ১৪ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। এই সময় শিক্ষকদের উপস্থিতি আরও বাড়বে এমন শঙ্কায় এ ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করে গতকাল আদেশ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
আদেশে বলা হয়, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষা কার্যক্রম যথাসময়ে সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে ইতিপূর্বে ঘোষিত আগামী ২০ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত এ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মাধ্যমিক/দাখিল, উচ্চ মাধ্যমিক/আলিম এবং কারিগরি /সমমান পর্যায়ের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করা হলো। বাতিলকৃত গ্রীষ্মকালীন ছুটি আগামী শীতকালীন ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠদান ও মূল্যায়নসহ অন্যান্য শ্রেণির পাঠদান ও পরীক্ষা কার্যক্রম শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হলো।
সম্পাদকঃ মাহবুবা আক্তার। অফিসঃ ৭৫ ই-ব্রডওয়ে,নিউইয়র্ক এনওয়াই ১০০০২।ফোন:+৮৮০১৭১২৯০৩৪০১ ই- মেইলঃ dailyhaquekotha@gmail.com
প্রকাশিত সংবাদপত্রের অংশ