কয়েকদিনের টানা ভর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে মাতামুহুরি নদী উপচে তলিয়ে গেছে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের অনেক এলাকা। তৈরি হয়েছে বন্যা পরিস্থিতি। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লাখো মানুষ। রাস্তা-ঘাট ঘর-বাড়িতে পানি উঠেছে কোমর সমান। যা আগে কখনো দেখেনি এসব এলাকার বাসিন্দারা। অনেক এলাকায় সাব-স্টেশনে পানি ঢুকে কয়েকদিন ধরে বন্ধ রয়েছে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। এতে সারাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তাদের। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে পাহাড়ি অঞ্চলে হঠাৎ বন্যা কেন, পরিস্থিতির উন্নতি কবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন—পাহাড়ি অঞ্চলে এমন ভয়াবহ বন্যার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকদিনের টানা ভর্ষণ অন্যতম। মাতামুহুরি ও সাঙ্গু নদীর ধারণ ক্ষমতার চেয়ে পানি বেশি হয়ে যাওয়াকে দুষছেন অনেকে।
সরদার উদয় রায়হান। বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের এই নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, বন্যার পেছনে মূল কারণ কয়েকদিনের বৃষ্টি। সাধারণত পুরো অগাস্ট মাসে গড়ে সাড়ে ৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় বান্দরবানে। এটিকে স্বাভাবিক হিসাবে দেখা হয়। কিন্তু চলতি মাসের চার থেকে ৮ তারিখ পর্যন্ত পাঁচ দিনেই বৃষ্টিপাত হয়েছে ৮০০ মিলিমিটার। যা অন্যান্যবারের তুলনায় পুরো আগস্টের দ্বিগুণ।
তিনি বলেন, অল্প সময়ে অধিক বৃষ্টিপাতে মাতামুহুরি ও সাঙ্গু নদীর স্বাভাবিক ধারণ ক্ষমতা পার হয়ে গেছে। ফলে বন্যা দেখা দিয়েছে। পাহাড়ের বিভিন্ন ঢল এবং বৃষ্টির পানি নদীতে একসাথে নামতে গিয়ে উপচে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। যেসব এলাকা দিয়ে এই দুটি নদী প্রবাহিত হয়েছে, তার আশপাশের এলাকা মূলত বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন— নিকট অতীতে এমন বন্যার উদাহরণ আর দেখা যায়নি। বান্দরবানের লামা পয়েন্টে নদীর পানি বাড়ার যে রেকর্ড ছিল, সেটা এর মধ্যেই পার হয়ে গেছে। গত ৫০ বছরে এই পয়েন্টে গড় সর্বোচ্চ রেকর্ড ছিল ৫০ মিটার। এবার সেটা হয়েছে ৫০ দশমিক ৪০ মিটার।
সরদার উদয় রায়হান বলেন, আমরা দেখেছি, প্রতিবছরই নানা কারণে দেশের নদ-নদীর পানি বহন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে অতীতে এসব নদী যে পরিমাণ পানি বহন করতে পারতো, সেটা হারিয়ে ফেলছে। এতে অধিক বৃষ্টিপাত হলে বা নদীতে পানি বেড়ে সহজেই আশপাশের এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পাহাড়ি অঞ্চলগুলোর নদীর কাছাকাছি নিচু এলাকায় আগে জনবসতি ছিল না। এখন জনসংখ্যার ঘনত্ব বেড়েছে। পাহাড়ি অঞ্চলের নিচু এলাকাগুলোতে ঘরবাড়ি তৈরি হয়েছে। এতে নদীর পানি বেড়ে গেলে বন্যাক্রান্ত হয়ে পড়ছে এখানকার বাসিন্দারা।
তবে শুধু অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, নদীর পানি বহন ক্ষমতা কমে যাওয়াকে দুষতে নারাজ অনেকে। তাদের মতে, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, অবকাঠামো নির্মাণসহ আরও বেশকিছু কারণ রয়েছে।
তোফায়েল আহমেদ একজন সাংবাদিক। কক্সবাজারের এই বাসিন্দা বলছেন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন তৈরির সময় অনেক জায়গায় একপাশ থেকে অন্যপাশে পানি চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। কোনো কালভার্টও দেওয়া হয়নি অনেক পয়েন্টে। এতে আগে পাহাড়ি বৃষ্টিপাতের পানি নামতে পারলেও এখন রেললাইনে আটকে যাচ্ছে। ফলে অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে এসব পানি লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
চকোরিয়ার বাসিন্দা মাহমুদুর রহমান বলছেন, আমাদের এলাকায় অনেক ছোট ছোট খাল বা নালা ছিল। স্থানীয় প্রভাবশালীরা সেগুলোতে বাঁধ দিয়ে চিংড়ির ঘের বানিয়েছেন। ফলে পাহাড় থেকে আসা পানি সরতে পারছে না। এছাড়া রেললাইনের কারণেও পানি সরতে পারছে না। এসব কারণে গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতেই আমাদের এলাকা তলিয়ে গেছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলার ৬০টি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ৪ লাখ ৮০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
অন্যদিকে বান্দরবানেও পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। এখন পর্যন্ত এই জেলায় ২১ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে সেখানে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানান।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, লোহাগড়া, কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া, বান্দরবানের রামু এবং রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির কিছু জায়গা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। তবে বুধবার (৯ আগস্ট) থেকে কিছু কিছু এলাকার পানি কমতে শুরু করেছে।
বান্দরবানে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কিছুই বলতে পারছেন না সংশ্লিস্ট কর্মকর্তারা। তাদের মতে, পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে আবহাওয়ার ওপর।
জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ বলেন, আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। এটা প্রাকৃতিক বিষয়। বৃষ্টি না থামলে আর নদীর পানি না কমলে আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব না কবে পুরো স্বাভাবিক হবে।
জেলার বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকায় তারা আপাতত বিদ্যুৎ চালু করছেন না। তবে নদীর পানি নেমে গেলেই আবার বিদ্যুৎ ব্যবস্থা চালু করা হবে।
বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সরদার উদয় রায়হান বলেছেন, আগামী দু’দিন ওই এলাকায় বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস নেই, নদীর পানিও কমতে শুরু করেছে। আশা করছি, দুই/তিন দিনের মধ্যেই বন্যার পানি নেমে যাবে।
বুধবার (৯ আগস্ট) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান বলেছেন, বন্যার পানি নেমে গেলেই ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করা হবে। আপাতত দুর্গত মানুষদের জন্য খাদ্য সহায়তা বরাদ্দ করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে এসব নদী যাতে খনন করা হয়, সেই সুপারিশও করা হবে।
সম্পাদকঃ মাহবুবা আক্তার। অফিসঃ ৭৫ ই-ব্রডওয়ে,নিউইয়র্ক এনওয়াই ১০০০২।ফোন:+৮৮০১৭১২৯০৩৪০১ ই- মেইলঃ dailyhaquekotha@gmail.com
প্রকাশিত সংবাদপত্রের অংশ