প্রতিনিধি ১৬ আগস্ট ২০২৩ , ৯:৪২:৩৭
গণতন্ত্রের নাম করে ভারত মহাসাগর ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে আক্রমণ করাই কারও কারও উদ্দেশ্য বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, সেই উদ্দেশ্যে তারা কাজ করছে। কারণ ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের এ অঞ্চলের গুরুত্ব অনেক বেশি। আমাদের বঙ্গোপসাগরটাও এরই অংশ। ভারত মহাসাগরে যতগুলো দেশ আছে এখানে কারও সঙ্গে কারও দ্বন্দ্ব নাই। স্বাধীনভাবে পণ্য চলাচল করে এখানে। তাই অনেকে এটিকে ব্যবহার করতে চায়। গতকাল বিকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এতে সূচনা বক্তব্য দেন- দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের কিছু আতেল আছে। তারা এসব চিন্তা করে কি না জানি না।
কিছু উপলব্ধি না করেই দু’টো পয়সার আশায় এদের সঙ্গে সুর মিলায়। এ বিষয়ে আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। একই সঙ্গে ভারত মহাসাগরের অন্যান্য দেশকেও সচেতন থাকতে হবে। আমি মনে করি তারা সচেতন। এ এলাকা নিয়ে নানা ধরনের চক্রান্ত চলছে।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০ বছর ধরে যেখানে সংঘাত ছিল। সেখানে আমি ক্ষমতায় আসার পর শান্তি ফিরিয়ে আনি। সেখানেও আবার নানারকম অশান্তি সৃষ্টির প্রচেষ্টা। যেহেতু আমি জানি, আমি বুঝি তাই কিভাবে আমাকে ক্ষমতা থেকে সরাবে এবং তাদের কিছু কেনা গোলাম আছে, পদলেহনকারী আছে, তাদের বসিয়ে এই জায়গাটা নিয়ে খেলবে। এটাই হচ্ছে প্রচেষ্টা। এটাই আমি ভালোভাবে বুঝতে পারি। তাই আমি দেশবাসীকে বলবো যারা দেশপ্রেমিক তাদের সবাইকে সজাগ এবং সতর্ক থাকতে হবে।
তিনি বলেন, আমি তাদের বলতে চাই- আপনাদের গণতন্ত্র কি আটলান্টিকে আটকে যায়? আটলান্টিক পর্যন্ত সীমাবদ্ধ? যে বিএনপি আমার বাবাসহ পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছে, ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে আজ তাদের নিয়ে ক্ষমতায় বসাতে হবে? এদের উদ্দেশ্য নির্বাচন না, গণতন্ত্র না। এরা একটা জিনিসই করতে চায় তা হচ্ছে-আমরা যে গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত করেছি, আর্থ-সামাজিক উন্নতি করেছি, দারিদ্র্যের হার কমিয়ে এনেছি, মাথাপিছু আয় বাড়িয়েছি সেই উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা। এটাই বাস্তবতা। আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, এখন নির্বাচন নিয়ে অনেকে উতলা হয়েছে। কারণটা কী? একের পর এক তারা বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছে। বিএনপি তাদের এখন চোখের মণি।
তাদের কাছে আমার প্রশ্ন- ২০০১ সালে যখন আমাদের নেতাকর্মীদের নির্যাতন করেছে, তখনতো নির্বাচন নিয়ে তাদের এতো মাথাব্যথা ছিল না। ’৯৬ সালে খালেদা জিয়ার বিতর্কিত নির্বাচন নিয়ে তো তাদের এমন চেতনা দেখিনি। খালেদা জিয়ার ভুয়া ভোটার নিয়েও তো তাদের কোনো উদ্বেগ দেখিনি। এ দেশের যারা ধ্বংসযজ্ঞ চালালো, তাদের সঙ্গে বসতে হবে কেন? আমার মনে হয়, বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা তাদের পছন্দ না। এদের উদ্দেশ্য, নির্বাচন বা গণতন্ত্র না। এরা উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চায়। তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য আর বাবার স্বপ্ন বাস্তবায়নে অনেক কিছু সহ্য করেছি। আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছি। অথচ খালেদা জিয়া আজিজ মার্কা নির্বাচন যখন করেছে তখন তাদের উদ্বেগ দেখিনি।
সরকারপ্রধান বলেন, যেসব দেশ খুনিদের আশ্রয় দিয়েছে তারা যখন আমাদের মানবতার কথা বলে, স্বচ্ছতার কথা বলে, সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলে তখন তাদের কাছে আমার প্রশ্ন ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর যখন বাংলাদেশে হত্যা, খুন, গুম, নির্যাতন, নিপীড়ন শুরু হয় তখন তারা কোথায় ছিল? ২০০১ সালের নির্বাচনেতো আমাদের হারার কথা ছিল না। এরশাদ যখন নির্বাচনের ফল আটকিয়ে রেখেছিল তখনতো এদের উদ্বেগ দেখিনি।
তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশের মানুষের ক্ষতি করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখি না। ২০০১ সালে গ্যাস বিক্রির কথা আসছিল, আমি বলেছিলাম- দেশের স্বার্থ বিক্রি করে ক্ষমতায় আসতে হবে, এত ক্ষমতালোভী আমি না। আমার বাবাও এমন ছিলেন না। তিনি বলেন, আজকে দেশের উন্নয়ন যখন করে যাচ্ছি, তখন সবার মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, কোনো খেলা খেলে বাংলাদেশের ভাগ্য নষ্ট করা যাবে না। দোয়া করবেন যেন জাতির পিতার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পারি।
কারো নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, আমাদের দেশের একজন সুদখোর আছে। শ্রমিকের অর্থ মেরে খায়। ট্যাক্স দেয়নি। গরিব থেকে উচ্চসুদে টাকা নিয়ে মেরে দিয়ে বিদেশে ব্যবসা করে। এটাই তো কথা। উনি তাদের প্রিয় ব্যক্তি। আর আমরা কাজ করি, মানুষের কল্যাণে। ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ড নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, যারা আমাদের বাড়িতে সব সময় ওঠা-বসা, খাওয়া-দাওয়া করেছে, তারাই বেঈমানি করেছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
জাতির পিতাকে হত্যা করে সংবিধান না মেনে খুনি মুশ্তাক নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে। প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেই জিয়াউর রহমানকে বানালো সেনাপ্রধান। ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জিয়াউর রহমান ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শেখ হাসিনা বলেন, মীর জাফর বেঈমানি করে তিন মাসও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি, দুই মাসের মাথায় তাকে চলে যেতে হয়েছিল। একই ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে। মুশ্তাককে বিদায় আর জিয়াউর রহমান নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতায় বসে। সেনাপ্রধান আবার প্রেসিডেন্ট, সংবিধান লঙ্ঘন করে, সেনা আইন লঙ্ঘন করে। তিনি বলেন, ১৫ই আগস্ট বাঙালির জাতীয় জীবনে সবচেয়ে একটি কলঙ্কময় অধ্যায়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল এই ১৫ই আগস্ট। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। একই সঙ্গে আমার মা, আমার তিন ভাই, কামাল-জামালের বউদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতিহাসের এ জঘন্য ঘটনা বাংলার মাটিতে ঘটে যায়। সেই কারবালার ঘটনাকেও যেন হার মানায়। কারবালার ঘটনা শিশু-নারীদের হত্যা করা হয়নি, কিন্তু ১৫ই আগস্ট শিশু-নারীদেরও তারা ছাড়েনি। তিনি বলেন, আমি আর আমার ছোট বোন রেহানা মাত্র ১৫ দিন আগে ৩০শে জুলাই জার্মানির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে ৩১শে জুলাই আমরা সেখানে পৌঁছাই।
আমরা ভাবতেও পারিনি আমাদের জীবনে এমন একটা আঘাত অপেক্ষা করছে। ১৩ তারিখে আব্বার সঙ্গে, মায়ের সঙ্গে, সবার সঙ্গে কথা হয়। ১৫ তারিখে এ ঘটনা ঘটার পর যখন আমরা জানতে পারি, তখন সব তথ্য আমরা জানতে পারিনি। শেখ হাসিনা বলেন, আমার আপনজন হারিয়েছি, স্বজন হারিয়েছি, বিদেশে রিফিউজি হিসেবে থাকতে হয়েছে। আমরা যারা আপনজন হারিয়েছি, আমারও তো সবচেয়ে বড় প্রশ্ন বাংলাদেশে কী হারিয়েছিল? বাংলাদেশের মানুষ কী হারিয়েছিল? তিনি বলেন, খুনিরা বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ফেলে। ইসলামী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশ বেতারের নাম পরিবর্তন করে রেডিও বাংলাদেশ করে। জয়বাংলা সেøাগান বাদ দিয়ে জিন্দাবাদ সেøাগান নিয়ে আসে। ইতিহাসই বিকৃতি করে। বাংলাদেশের মানুষের উন্নতির সব স্বপ্ন বন্ধ হয়ে যায়। খুনি মুশ্তাক নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলো, জিয়াকে সেনাপ্রাধান বানালো। জিয়াউর রহমান এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মীর জাফর যেমন তিন মাসের বেশি থাকতে পারেনি। তেমনি মুশ্তাকও থাকতে পারেনি।
জিয়া ক্ষমতা দখল করে। উর্দি পরে ক্ষমতারোহণ এবং পরে নিজেকে রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করারও চেষ্টা করে। আর্মি রুলস ভঙ্গ করে একটা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও করে। ভোট কারচুপি ও ভোটচুরি তো সেখান থেকে শুরু। এরপর বিএনপি নামক সেই দল করে। এ সময় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ১৯৭৫ সালের বীরপুরুষ কর্নেল জামিল, আমরা সবাই কাপুরুষ। আমাদের যাদের বঙ্গবন্ধু ডেকেছিলেন, ভয়ে সাড়া দেননি, তাদের বীরপুরুষ বলা যাবে? আমরা কাপুরুষ। ইতিহাসে এ সত্যকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তিনি বলেন, সব সত্য আমরা এখনো জানি না। সব সত্য এখনো বের হয়ে আসেনি।
অজানা অনেক তথ্য রয়ে গেছে। সত্য প্রকাশ হবেই। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন, সেখানে অনেক সত্য বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু এ সত্য আমরা কতজনে স্বীকার করি? ৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু কয়েকজনকে ফোন করেছিলেন। কে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন? সত্য যদি বলতে হয়, শুধুমাত্র কর্নেল জামিল ছুটে এসেছিলেন ৩২ নম্বরে। আমাদের কোনো নেতা আসেননি। আমরা কেউ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ৩২ নম্বরে আসিনি। ঘাতকরা যখন গুলি করছিল তখন বঙ্গবন্ধু কর্নেল জামিলকে ফোন করেছিলেন, কর্নেল জামিল কোনো বাধা মানেননি। তিনি ছুটে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভবনের দিকে, আর তাকে পথের মধ্যেই হত্যা করা হয়।
তিনি বলেন, আমরা আমাদের বিবেকের কাছে অপরাধী। বঙ্গবন্ধুর জন্য আমরা বড় পদে এসেছি, বড় নেতা হয়েছি। জামিল যে সাহস, আনুগত্য, দেশপ্রেম দেখিয়েছিলেন সেটা কি কোনো পলিটিশিয়ান দেখাতে পেরেছেন? পারেননি। এটাই সত্য। আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেনÑ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি, সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন, কার্যনির্বাহী সদস্য এডভোকেট তারানা হালিম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির, উত্তরের সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি প্রমুখ। সঞ্চালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ এবং উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আব্দুল আওয়াল শামীম।