প্রতিনিধি ২৪ আগস্ট ২০২৩ , ১২:০৫:১৬
রিয়াজুল জান্নাত বা জান্নতের বাগিচা বলা হয় রাসুল সাঃ এর হুজরাত থেকে তার মিম্বার পর্যন্ত জায়গাটিকে, যার দৈর্ঘ্য ২২ মিটার এবং প্রস্থ ১৫ মিটার। নবীজী সাঃ এর রওজা জিয়ারাত ও রিয়াজুল জান্নাতে নামাজ পড়ার সাধ জাগে না এমন কোনো মুসলিম আছে কি!? পুরুষদের জন্য এই দুটি কাজ মহিলাদের তুলনায় সহজ।
রিয়াজুল জান্নাতে দিনে তিনবার মহিলাদের যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। ফজর, যোহর এবং এশার নামাজের পর। মদিনায় এসেই আগে ভলিন্টিয়ারের কাছ থেকে সময় নিশ্চিত হয়ে নেয়া ভালো। এছাড়া আপনি যে ওয়াক্তে যেতে চাচ্ছেন, সে ওয়াক্তের আজানের কমপক্ষে আধাঘন্টা আগে মসজিদে পৌছে ভলিন্টিয়ারের কাছ থেকে দিক নির্দেশনা নিয়ে নিতে পারেন।
মহিলাদের নামাজের জন্য তো মসজিদে কতো জায়গা-ই আছে। রিয়াজুল জান্নাতে যেতে চাইলে যেকোন এক জায়গায় বসে নামাজ পড়লেই হবে না। আপনাকে ২৫ নং গেট দিয়ে মসজিদে ঢুকতে হবে। আজানের আধাঘন্টা আগে ২৫ নং গেট দিয়ে ঢুকবেন। মসজিদের ভিতরের দিকে যেতে থাকবেন। সামনে দেখবেন কাঠের পার্টিশান দেয়া মহিলাদের নামাজের জায়গা। এই ঘেরাও দেয়া অংশে সাধারণত বাচ্চাদের নিয়ে ঢুকতে দেয় না। পার্টিশন দেয়া অংশে ঢুকে বামপাশে যেতে থাকবেন।
বাম পাশে একটা গেট আছে, গেট নং ৩১। গেটের নাম বাব-এ-আলী ইবনে আবি তালিব। মিলেছে??? মিলে গেলে কিবলামুখী হয়ে নামাজের কার্পেটের সামনের দিকে যেতে থাকুন, যতোটা যাওয়া যায়। কিবলার দিকে আরেকটা কাঠের পার্টিশান, তার ঐপাশে গেট নাম্বার ৩২নং লেখা। আপনি যেপাশে বসেছেন তার ডান দিকে সাদা পর্দা দিয়ে পার্টিশান দেয়া। নিশ্চিন্তে বসুন, ঠিক জায়গা মতোই এসেছেন। বেশি বেশি দরুদ শরীফ পড়তে থাকুন। একমনে দরুদ শরীফ পড়ুন, তওবা-ইস্তিগফার পড়ুন।
নামাজের পর নির্দিষ্ট সময়ে সামনের কাঠের পার্টিশান সরিয়ে রওজায় যাওয়ার রাস্তা খুলে দিবে। সবাই এসময় খুব হুলস্থূল করে। ধৈর্য ধরুন। নবীজী সাঃ এর সাথে সাক্ষাতে যাচ্ছেন, বেয়াদবি হয়ে যায় এমন কিছু করবেন না। আপনার সেজদার জায়গা আল্লাহ নির্দিষ্ট করেই রেখেছেন। বেশি করে দোয়া করবেন যেন আল্লাহ সব কাজ সহজ ও সুন্দর করে দেন।
অনেকটা পথ হেটে পৌছে গিয়েছেন সেই বহু কাংখিত জান্নাতের বাগিচায়! আপনি দাড়িয়ে আছেন সবুজ কার্পেটে। শুরুর দিকে ভীড় তুলনামূলক কম থাকে। অর্থাৎ প্রথম ব্যাচ ভীড় কম পায়। যতো নতুন ব্যাচ ঢুকাতে থাকে, ততো ভীড় বাড়ে। তাই শুরুতেই সামনে এগিয়ে যান, একেবারে সামনে। সামনে সাদা পর্দা, তা ঘেষে এক কাতার নামাজের জায়গায় সবচেয়ে বেশি ভীড়। এটা মূল রিয়াজুল জান্নাতের অংশ। ধৈর্য ধরে, লাইনে দাড়িয়ে নামাজ পড়ার চেষ্টা করুন। এখানে দুই রাকাআত নফল নামাজ পড়ার জন্য বলা হয়। আবেগে নামাজ দীর্ঘ করা উচিত না। আপনার মতো অন্যরাও নামাজ পড়ার জন্য অস্থির হয়ে আছে।
নামাজ শেষে একটু পিছনে সরে আসুন। পর্দার ঐপাশে বামদিকে সোনালি ক্যালিওগ্রাফি দেখা যাচ্ছে। পেয়েছেন? দরুদ ও সালাম পেশ করুন নবীজী সাঃ এর রওজায়। পাশে হালকা সোনালী ক্যালিওগ্রাফি, হযরত আবু বকর রাঃ এবং হযরত উমর রাঃ কে সালাম জানান। এবার কিবলার দিকে দেখুন, তিনকোনা একটা কিছু দেখা যাচ্ছে। জায়গাটার নাম মুসাল্লায়ে রাসুল সাঃ বা উস্তুওয়ানায়ে হান্নানাহ। নবীজী সাঃ এই স্থানে দাড়িয়ে নামাজ পড়াতেন। হান্নানাহ একটি খেজুর গাছের নাম। মিম্বার তৈরির আগে এই খেজুর গাছে হেলান দিয়ে নবীজী সাঃ জুমআর খুতবা দিতেন বা দ্বীনি তালিম দিতেন। যখন মিম্বারে দাড়িয়ে নবীজী সাঃ খুতবা দেয়া শুরু করলেন, তখন এই গাছ কেঁদেছিল এবং আল্লাহর ইচ্ছায় উপস্থিত মুসল্লিগণ সে আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। আরো অনেক ঘটনা আছে এই গাছ ঘিরে। হযরত উমর রাঃ এর খেলাফতের সময় নবীজী সাঃ এর নামাজের জায়গায় তিনি মেহরাব তৈরি করেন, নবীজী সাঃ এর সেজদার স্থানে প্রশস্থ দেয়াল তুলে দেন এবং দাড়ানোর স্থান ফাঁকা রেখেছেন।
মহিলারা এতো কিছু দেখার সুযোগ পায় না। তিনকোণা স্তম্ভের মতো দেখে বুঝবেন ওইটা নবীজীর সাঃ মেহরাব বা মুসাল্লায়ে রাসুল সাঃ। এরপর হাতের ডানদিকে খেয়াল করুন। মিম্বারের দরজা কিছুটা দেখা যায়। এই সেই মিম্বার যেখানে দাড়িয়ে আল্লাহর রাসুল সাঃ জুমআর খুতবা দিতেন। হাদিসে এসেছে, এই মিম্বারের নিচ থেকে হাউজে কাউসার এর উৎপত্তি ঘটবে।
আরো ডানদিকে সাদা, উঁচু স্টেজের মতো একটা অংশ; এখানে দাঁড়িয়ে আজান দেয়া হয়। রিয়াজুল জান্নাতের কিছু বিশেষ/স্পেশাল পিলার আছে। বেশিরভাগ পিলার সাদা পর্দার ঐপাশে, ৬নং পিলার ছাড়া(এই লেখাটা ছবির সাথে মিলিয়ে দেখবেন)। পর্দার ঐপাশে, বামে, নবীজী সাঃ এর রওজার সবুজ পার্টিশনে, দুইটা পিলার। কিবলার দিকের পিলারের নাম(২নং) উস্তুওয়ানায়ে সারীর, নবীজী সাঃ এখানে ইতিকাফে বসতেন। তারপাশের পিলার, পর্দার সাথে লাগানো, তার নাম(৫নং) উস্তুওয়ানায়ে আলী; হযরত আলী রাঃ এখানে বসে পাহারা দিতেন। একই লাইনে পর্দার এপাশের পিলারের নাম(৬নং) উস্তুওয়ানায়ে উফুদ; বিভিন্ন গোত্র থেকে আসা প্রতিনিধিদল এই স্থানে বসতেন, ইসলাম গ্রহণ করতেন এবং ধর্মীয় উপদেশ শুনতেন।
পর্দার ঐপাশে মেহরাবের আগে, উস্তুওয়ানায়ে সারীর বরাবর একই লাইনে, পিলারটির নাম (৩নং) উস্তুওয়ানায়ে তওবাহ। আবু লুবাবা রাঃ নামে এক প্রসিদ্ধ সাহাবা ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ইহুদি গোত্র বনু কুরায়জার সাথে তার যোগাযোগ ছিল। খন্দকের যুদ্ধে নিজের কোনো এক ভুল কাজের কারণে তিনি অনুতপ্ত ছিলেন। তওবার আশায় তখনকার সময়ে এই পিলারের স্থানে থাকা খেজুর গাছের সাথে নিজেকে নিজে বেধে রেখেছিলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যতোক্ষণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা তাকে ক্ষমা না করবেন এবং নবীজী সাঃ নিজ হাতে তাকে মুক্ত না করবেন ততোদিন তিনি এভাবেই থাকবেন। নবীজী সাঃ কে সাহাবীরা ব্যাপারটা জানালে তিনি বলেছিলেন, “আবু লুবাবা আমার কাছে এসে বললে আমি তার হয়ে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাতাম কিন্তু যেহেতু সে নিজে থেকে এমন শর্ত তৈরি করেছেন, এখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা না করলে আমি তার বাধন খুলে দিতে পারি না”। আবু লুবাবা খাওয়া-পানব্যতীত দীর্ঘদিন কান্নাকাটি করে একাকার হয়েছেন, ক্ষমা লাভের আশায়। নামাজের সময় তার স্ত্রী বা কন্যা তাকে মুক্ত করে দিতেন আবার নামাজ শেষে বেধে দিতেন। একটা সময় তার শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়; তবুও প্রতিজ্ঞায় অনড় ছিলেন। প্রায় দুই মাস মতান্তরে ৫০ দিন পর, একদিন তাহাজ্জুদের নামাজের ওয়াক্তে নবীজী সাঃ সুসংবাদ পান যে আল্লাহ তার ভুলক্রটি ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং নিজ হাতে প্রিয় সাহাবীর বাধন খুলে দেন। সুবহানআল্লাহ!
উস্তুওয়ানায়ে তওবাহ-র ডানদিকের পিলার(৪ নং), যার নাম উস্তুওয়ানায়ে আয়েশা রাঃ। রিয়াজুল জান্নাত সম্পর্কে সেই বিখ্যাত হাদীস, “আমার মসজিদে এমন একটি জায়গা রয়েছে। লোকজন যদি সেখানে নামাজ পড়ার ফজিলত জানত, তাহলে সেখানে স্থান পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করত।” হাদীস বর্ননা করেছিলেন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাঃ। সাহাবীগণ সেই জায়গা চেনার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন কিন্তু তিনি চিনিয়ে দিতে রাজি হননি। পরবর্তীতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাঃ কে এই জায়গা চিনিয়ে দিয়েছিলেন এবং হিসেব মিলিয়ে দেখা যায় যে হযরত আবু বকর রাঃ ও হযরত উমর রাঃ বেশিরভাগ সময় এইস্থানে নামাজ পড়তেন। এই পিলারের নাম আয়েশা স্তম্ভ/উস্তুওয়ানায়ে আয়েশা রাঃ।
রিয়াজুল জান্নাতে নামাজ পড়েছেন, নবীজী সাঃ কে একদম কাছ থেকে সালাম জানিয়েছেন। তারপরও মন খারাপ? গোল্ডেন গেটের ঐ ছিদ্র দিয়ে দেখতে পারলেন না, তাই মন খারাপ হচ্ছে??? আমারও মন খারাপ হতো। মনে হতো, আমরা কম পাচ্ছি। গোল্ডেন গেটের ঐ ছিদ্র দিয়ে সবুজ/পেস্ট কালারের গিলাফ, মা ফাতেমার ব্যবহৃত খাট(গিলাফে আবৃত) ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। নবীজী সাঃ এর কবর তার ঘরের ভিতরে, ঘরটি মাটির উপরে ২-৩ধাপে দেয়াল দিয়ে ঘেরাও দেয়া আর মাটির নিচে মদিনার ওয়াটার লেভেল পর্যন্ত সীসা-লোহার ঢালাই করা। সবচেয়ে বাহিরের দেয়াল পেস্ট কালারের গিলাফে আবৃত।