প্রতিনিধি ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ১২:২৬:১১
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের মানবাধিকার ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে। বাংলাদেশ সরকার এরইমধ্যে এ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে। এ প্রস্তাব পাসের বাস্তবিক প্রভাব কী? রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি সিরিয়াসলি নেয়া উচিত। মানবাধিকার, গণতন্ত্রের বিষয়ে ইইউ প্রতিনিধিরা বরাবরই সোচ্চার। বর্তমান সরকার বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে না নিলে সামগ্রিকভাবে দেশের ক্ষতি হবে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান মানবজমিনকে বলেছেন, ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশ নিয়ে যে প্রস্তাবগুলো পাস হয়েছে কিংবা উপস্থাপিত হয়েছে এসব বিষয়ে আমি মনে করি আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে। আমরা গার্মেন্ট ব্যবসা করছি, এটা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে জি টু জি একটা এক্সেস আছে। এই মুহূর্তে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি না। ইউরোপীয় ইউনিয়নে জি টু জি এক্সেসটা আমাদের ব্যবসার, গার্মেন্ট শিল্প ও দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন আমাদের সবার দায়িত্ব বেড়ে গেছে। আমি মনে করি সরকার এই বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে দেখবে।
আগামী নির্বাচনটা নিয়েই সবার চিন্তা। অবাধ, সুষ্ঠু এবং সুন্দরভাবে নির্বাচনটা হলে এটা নিয়ে আর কোনো সমস্যা হবে না।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটি সদস্য ও ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সরকারের যত অপকর্ম রয়েছে এগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছেছে। বাংলাদেশকে বলতেছে এসব অপকর্ম বন্ধ করো। শুধু সরকার নয়, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারের কর্মকর্তা সবাইকে এখানে (ইইউ’র প্রস্তাবে) নিয়ে আসছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বাংলাদেশের সরকার, বিচার বিভাগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তাদের কর্মকা- নিয়ে প্রশ্ন করছে। সবকিছু মিলিয়ে ভোট, মানবাধিকার, দুঃশাসন, জনগণের জীবনের নিরাপত্তা এই বিষয়গুলো ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাবে নিয়ে এসেছে। এখানো কোনো কিছু বাকি নেই। তারা (সরকার) যদি এখনো এই বার্তা না পায়, যে তাদেরকে বিশ্ববাসী কী বলতে চাচ্ছে। তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন সরকারের নানা কর্মকা-ের জন্য আজ সবকিছু প্রশ্নবিদ্ধ। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশের মানবাধিকারসহ যে প্রস্তাবগুলো পাস হয়েছে, তার প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়বে।
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশের যেসব বিষয়গুলো নিয়ে প্রস্তাব পাস হয়েছে, সেটা নিয়ে দেশে কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে হচ্ছে না। আমার কাছে মনে হয় এই জিনিসটা পলিটিক্যাল মোটিভেটেড। কারণ বাংলাদেশে এমন কিছু হয়নি। যারা মানবাধিকার নিয়ে কথা বলে তারা (ইইউ) মিয়ানমারের ওপরে এমন কোনো প্রস্তাব আনেনি। যারা রোহিঙ্গাদের এত অত্যাচার করলো তাদের ওপর কেন এমন প্রস্তাব আসলো না। এসব থেকে বোঝা যায় এটা পুরোটাই রাজনৈতিক বিষয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক তানজীম উদ্দিন খান বলেন, যারা সরকারবিরোধী আন্দোলন করছে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছে, যাদের যে অভিযোগ বিশেষ করে মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত, গুম, খুন, পুলিশি নির্যাতন সেগুলো এই বিল পাস হওয়ার মধ্যদিয়ে স্বীকৃতি পেলো। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে প্রস্তাবটি রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে সরকার বিরোধীদের চাঙ্গা করবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাবমূর্তিও বিশ্ববাসীর কাছে একটা অন্য রকম ধারণা তৈরি করবে। এতদিন পর্যন্ত ধারণা ছিল যে বাংলাদেশে উন্নয়নের রাজপথে আছে, সেই উন্নয়ন কতো কিছুর বিনিয়মে আমরা আছি সেটাও বিশ্ববাসী জানবে। সেদিক থেকে যারা সরকারবিরোধী আন্দোলনে আছে তারা আরও বেশি উৎসাহিত হবে। সরকারের ওপরে এটা কোনো প্রভাব তৈরি করবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ১৪ই সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় পার্লামেন্টে যে বিষয়গুলো পাস হয়েছে তার মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় আছে। একটি হচ্ছে জিএসপি সংক্রান্ত, অন্যটি হচ্ছে ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ (ইবিএ)। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইবিএ সুবিধা অব্যাহত রাখা উচিত কিনা তা পুনর্বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। আমাদের এখন যে সামগ্রিক পরিস্থিতির যদি উন্নয়ন না ঘটে, তাহলে আমরা অর্থনৈতিক দিক থেকে ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছি। সরকারের ওপর প্রভাবের বিষয়টি হচ্ছে যে, যখন যারা ক্ষমতায় থাকে তখন তারা সবকিছুকে উপেক্ষা, তুচ্ছ করার একটা প্রবণতা আছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। যার ফলে আন্তর্জাতিক মহলে আমার যে চাপ দেখছি, অভিযোগগুলো যে এক ধরনের স্বীকৃতি সেটা ওনারা (ক্ষমতাসীন সরকার) কতোটুকু সিরিয়াসলি নিবেন এটা নিয়ে আমার খুব সন্দেহ আছে। কারণ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটা একটা বড় সমস্যার জায়গা। যে তারা দেশকে গুরুত্ব না দিয়ে তারা তাদের নিজেদের রাজনীতিক স্বার্থ, ব্যক্তি স্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখতে চায়।
গৃহীত প্রস্তাবে ইইউ’র পার্লামেন্টের সদস্য বলছেন, বাংলাদেশকে অবশ্যই তাদের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার, বিশেষ করে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো মেনে চলতে হবে। মানবাধিকার বিষয়গুলোসহ এনজিও, মানবাধিকার সংস্থা এবং কর্মী, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিতের জন্যও বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানান তারা। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর দুই নেতা আদিলুর রহমান খান এবং এএসএম নাসির উদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে দ-াদেশের নিন্দাও জানায় ইউরোপীয় পার্লামেন্ট।
গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন ও ন্যায়সঙ্গতভাবে পরিচালিত হয় এবং সব পক্ষের অধিকার সম্মানের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত করে চলেছে। বিচারাধীন বিষয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে যৌথ প্রস্তাব উত্থাপন এবং ঢাকায় দুই ‘অধিকার’ কর্মকর্তার বিষয়ে আদালতের রায় নিয়ে যে কথা বলা হয়েছে তা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের শামিল। বাংলাদেশ সরকার ‘অধিকার’- বিষয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের রেজ্যুলেশন সম্পূর্ণ পক্ষপাতিত্বমূলক।