প্রতিনিধি ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ৪:২৫:১৭
লিভার সিরোসিস’সহ বেশ কিছু শারীরিক জটিলতা নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় দিনের পর দিন ধুঁকছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) সেটআপে কেবিনেই চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন তিনি।গোপন সূত্রে জানা যায় বেগম খালেদা জিয়ার অবস্থা খুব একটা ভাল নয়।এমন অবস্থায় এর মধ্যে হঠাৎ শর্ত শিথিল করে ‘শিগগিরই’ খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেবে সরকার- এমন জোর গুঞ্জন চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। তবে বিএনপি প্রধানের মুক্তি মিলছে কোন প্রক্রিয়ায়- রাজনৈতিক চাপ, সমাঝোতা নাকি মানবিকতায়? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন অনেকেই।
সরকারের নির্বাহী আদেশে কারামুক্তি পেয়ে বর্তমানে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠাতে বিএনপি ও তার পরিবার দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে। এরই মধ্যে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে তাকে দ্বিতীয় দফায় নেওয়া হয়েছে হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ)।এদিকে তার অবস্থা ‘সংকটজনক’ বলে দাবি করছেন বিএনপি নেতারা। এবার তাকে মুক্তির পাশাপাশি উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন তারা।
অন্যদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে ভাবতে শুরু করেছে সরকার। এ বিষয়ে ইতিবাচকভাবে আইনি দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে সরকার সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা অবনতির বিষয়টি সরকারের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। এ অবস্থায় কোনো রকম দুর্ঘটনা ঘটে গেলে তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হতে পারে। এ কারণে সরকারও বিষয়টি নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় যে কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির দণ্ড মওকুফ বা স্থগিতের পুরোপুরি ক্ষমতা সরকারের রয়েছে। এটা শর্তসাপেক্ষে প্রয়োগ হতে পারে, আবার শর্তহীনও হতে পারে। সরকার ইচ্ছা করলেই এই ধারার প্রয়োগ করে যে কারও দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করতে পারে। যেমনটি পারেন রাষ্ট্রপতিও। পাশাপাশি দণ্ড প্রদানকারী আদালতেরও এই ক্ষমতা প্রয়োগের এখতিয়ার রয়েছে।
তবে গতকাল সোমবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘তাকে ৪০১ ধারায় যে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, এটার কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। আইনের অবস্থান থেকে সরকারের আর কিছু করার নেই। আর করতে হলে আগের শর্তযুক্ত মুক্তির আদেশ বাতিল করতে হবে।’
তবে বিদেশে চিকিৎসার আবেদনের ব্যাপারে গত রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ ধরনের আবেদন করা হলে আমরা আইনি মতামতের জন্য সেটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাই। আইন মন্ত্রণালয় যদি মনে করে সেটি আদালতে পাঠানো দরকার, তাহলে পাঠাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিবারই তারা আবেদন করেন, আমরা যতটুকু মঞ্জুর করতে পারি, সেটুকুই আমরা মঞ্জুর করে দিচ্ছি। এরপর করতে হলে আদালতে যেতে হবে। আমরা আদালতের বাইরে যতখানি করতে পারি, সেটুকু করছি।’
সরকারের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়ার বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি পরিষ্কার করা না হলেও একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে সরকারের ভেতরে আলোচনা চলছে। তাকে সরকারের তরফ থেকে দেশের বাইরে পাঠানোর কোনো সিদ্ধান্ত না হলেও শেষ পর্যন্ত বিষয়টি আদালতের অনুমতির জন্য পাঠানো হতে পারে। এক্ষেত্রে আইনেও সুযোগ রয়েছে।
জানতে চাইলে আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক কালবেলাকে বলেন, ‘সরকার প্রথমত খালেদা জিয়ার দণ্ড স্থগিত করে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয়। সেখানে দুটি শর্ত দেওয়া হলো, নিজের বাসায় থাকার এবং দেশের হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার। ছয় মাস শেষ হওয়ার পর আরও ছয় মাস বাড়াল। এভাবে প্রতিবার বাড়ানো হচ্ছে। প্রতিবারই কিন্তু নতুন আদেশ দিতে হচ্ছে। এর অর্থ, শর্ত পরিবর্তন হচ্ছে। বারবার শর্ত পরিবর্তন করছে। এখন শর্ত পরিবর্তন করে, দেশের হাসপাতালের জায়গায় যে কোনো হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিতে পারবেন যুক্ত করলেই তো হয়ে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার মনে হয় আইনের অবস্থান থেকে সরকারের আর কিছু করার নেই।’
সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশে আইনের শাসন আছে। আমরা আদালতের রায়কে শ্রদ্ধা করি। আদালতের রায় আছে। আদালত তাকে শাস্তি দিয়েছে। ৪০১ ধারায় তাকে শর্তযুক্ত যে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, তা সরকারের নির্বাহী আদেশ দেওয়া হয়েছে। তার শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করেই এবং শর্তযুক্তভাবেই যে, শর্ত তিনি মেনেছেন। জাতিসংঘের কথা বলা হচ্ছে। একটা কথা জাতিসংঘে বলা আছে। সেটা হচ্ছে, আমাদের দেশের আইনটা অগ্রাধিকার পাবে এবং সেক্ষেত্রে আমাদের দেশের আইনে যে অবস্থান তাকে ৪০১ ধারায় মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আমি বহুবার বলেছি, এ আইনের অবস্থায় এটার কোনো পরিবর্তন করা যাবে না।’
এদিকে গত রোববার বিকেলে নয়াপল্টনে ঢাকা মহানগর বিএনপি আয়োজিত সমাবেশে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, কোনো ছলচাতুরি করে লাভ নেই, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসা করাতে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘খালেদা জিয়া অত্যন্ত অসুস্থ। এত অসুস্থ যে, এখন তার চিকিৎসকরা বলেছেন, আপনাদের কিছু করার থাকলে করেন। অবিলম্বে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে না পারলে তাকে বাঁচানো দুষ্কর হয়ে যাবে।’
৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটামের পর সরকার দাবি না মানলে কী হবে—এমন প্রশ্নে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘সেক্ষেত্রে কী হবে সেটা যথাসময়ে মহাসচিব বলবেন। খালেদা জিয়ার সঙ্গে মহাসচিব একা দেখা করেছেন। সেখানে আমরা কেউ ছিলাম না। এ আলটিমেটাম খুবই বাস্তবসম্মত ও ন্যায়সংগত। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরকারের সাড়া পাওয়া না গেলে দলের মহাসচিব পরবর্তী কর্মসূচি দেবেন।’
বিএনপির এই আলটিমেটামের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া চাওয়া হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার কোনো বক্তব্য নেই।’
তবে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে বিএনপি রাজনীতি করার অপচেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গত রোববার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘বিএনপি কোনো আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে পারেনি; বরং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদার মানবিকতার কারণে একজন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হয়েও খালেদা জিয়া নিজ বাসায় বসবাস ও পছন্দমতো চিকিৎসা নিতে পারছেন। খালেদা জিয়ার প্রতি মানবিকতা দেখানোর কারণে বিএনপি নেতাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত; কিন্তু বিএনপি তা না করে মিথ্যাচারের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করছে। একই সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে আইনবিরোধী কথাবার্তা বলছে।’