ইতিহাস ঐতিহ্য

‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী

  প্রতিনিধি ৫ ডিসেম্বর ২০২৩ , ১০:৪১:৩৬

0Shares

শেয়ার করুন

✍️ ‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী’ সুদূর বৈরুতের একটি হোটেলের নির্জন কক্ষে ১৯৬৩ সালের ০৫ ই ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। ‘শহীদ সোহরাওয়ার্দী’কে ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। মননে প্রত্যয়ে, চিন্তা-চেতনা ও মননশীলতায়; তিনি শুধু গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীলই ছিলেন না, তিনি বিশ্বাস করতেন- গণতন্ত্র হচ্ছে সহনশীলতার পরীক্ষা। তিনি ওয়েস্ট মিনিস্টার ধরনের গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। কেননা- তার ধারণা ছিল রাষ্ট্রপতি ৫ বছরের জন্য একবার নির্বাচিত হলে, তিনি অপ্রতিরোধ্য হয়ে যান। অবিভক্ত বাংলার প্রিমিয়ার ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, অবিভক্ত পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সরদার হায়াত খান। পাঞ্জাব বিভক্ত হলে সরদার হায়াত খান স্বাভাবিকভাবেই পাঞ্জাবের পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত অংশের মুখ্যমন্ত্রী রয়ে গেলেন, কোনো আস্থা ভোটের প্রয়োজন হল না। কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জন্য আস্থা ভোটের নির্দেশ দেন জিন্নাহ সাহেব স্বয়ং। জিন্নাহর পৃষ্ঠপোষকতায় নাজিমুদ্দিন, আকরাম সাহেবদের সূক্ষ কূটকৌশলের মর্মান্তিক শিকার হন শহীদ সাহেব। এখানেও তিনি আদর্শ ও নিষ্ঠার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। সিলেট থেকে নির্বাচিত সদস্যরা সিলেটের ভোটের বিনিময়ে একটি মন্ত্রীর পদ নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আদর্শে অনড় শহীদ সাহেব সিলেটের সাংসদদের সুস্পষ্ট জানিয়ে দেন যে- প্রয়োজনে একাধিক মন্ত্রী সিলেট থেকে বানানো হবে, কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি সাংসদদের ভোট ক্রয় করবেন না। ক্রুদ্ধ সিলেটের সাংসদরা একযোগে নাজিমউদ্দীন সাহেবকে ভোট প্রদান করলে, আস্থা ভোটে পরাজয় বরণ করে মুখ্যমন্ত্রীর পদ হারালেও, তিনি বিন্দুমাত্র আফসোস করেননি।

🟡 রাজনীতিতে তিনি কোনোদিন কোনো অবস্থাতেই শঠতার আশ্রয় নেননি। রূপা নয়, সোনা নয়- হীরার চামচ মুখে নিয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জ্ঞানচর্চার যে সুউচ্চ শিখরে তিনি আরোহণ করেছিলেন, সেটি অনন্যসাধারণ। তা সত্ত্বেও (নীল) রক্তের কণায়-কণায়, অনুভূতির পরতে পরতে মাটি ও মানুষের প্রতি তার ছিল গভীর মমত্ববোধ। উপমহাদেশের রাজনীতিতে তার ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্রের আঙ্গিক হল- তিনি যা বিশ্বাস করতেন; তার রাজনৈতিক ধারা ও জীবনধারা সেই স্রোতেই প্রবাহিত হত। বিলেত থেকে ফেরত এসে এই অভিজাত পরিবারের সন্তানটি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের “স্বরাজ পার্টি”র সঙ্গে তার দলীয় রাজনীতির হাতেখড়ি। নতুন প্রজন্ম বিস্ময়াভিভূত হবেন চিত্তরঞ্জন দাশ শুধু অসাম্প্রদায়িক ছিলেন না- শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থ-বিত্ত, সাহিত্য-সংস্কৃতি, চাকরি এবং ব্যবসায় অনেক পিছিয়ে থাকা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে টেনে তোলার তাগিদে দেশবন্ধুর স্লোগান ছিল- সর্বক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্য শতকরা ৫৫ ভাগ কোটা বরাদ্দ অবশ্যই করতে হবে।

🟡 দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অভাবনীয় অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার আকর্ষণে, তিনি স্বরাজ পার্টিতে যোগদান করেন। দেশবন্ধু যখন কলকাতা সিটি করপোরেশনের মেয়র, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত হন এবং নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস প্রধান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে তখন একটি প্রবাদ প্রচলিত হয়েছিল যে, দেশবন্ধুর দুটি অনবদ্য সৃষ্টি শহীদ ও সুভাষ। সোহরাওয়ার্দী সমস্ত আভিজাত্যের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে ডকইয়ার্ড শ্রমিক, ধাঙড় থেকে শুরু করে নিম্ন গোত্রের হিন্দু-মুসলমান সবাইকে নিয়ে তার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল তৈরি করেন। উল্লেখ্য, ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল ঢাকার আহসান মঞ্জিলে। নবাব, জমিদার, খান বাহাদুরদের প্রাসাদে ঘুরপাক খেত সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও হিসাব-নিকাশ। তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতিকে আভিজাত্যের প্রাসাদ থেকে মাটি ও মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসায় অনবদ্য ভূমিকা রাখেন। ফলশ্রুতিতে যা হওয়ার তাই হয়েছে। মুসলিম লীগের নেতৃত্ব আগলে থাকা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কারিগররা, এমনকি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে আস্থায় নেয়া দূরে থাক, তার যোগ্যতাকে ব্যবহার পর্যন্ত করেননি। তার রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতা। আবুল হাশিম সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগকে তিনি প্রচণ্ড শক্তিশালী সংগঠনে রূপান্তরিত করেন এবং তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রিমিয়ার পদে অধিষ্ঠিত হন। ‘৪৬’ এর নির্বাচনে সোহরাওয়ার্দী এবং হাশিম সাহেবদের ভূমিকাই মুখ্য ছিল। লাহোর প্রস্তাবে শরৎ বোসকে সঙ্গে নিয়ে, তিনি অবিভক্ত বাংলার একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে হলেও পাকিস্তান না হলে, বাংলাদেশের অভ্যুদয় হত না। রক্ষণশীল হিন্দু নেতৃত্বের একটি অংশ তাকে ডাইরেক্ট অ্যাকশন দিবসের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে অভিযুক্ত করার প্রচণ্ড অপচেষ্টা চালিয়েছিল। তবে গান্ধীজি এই অভিযোগটিকে গ্রহণ করেননি, কারণ তিনি সত্যটা জানতেন। শুধু অবিভক্ত বঙ্গের প্রিমিয়ার নয়, কলকাতার মুসলমানদের কাছে তিনি ছিলেন মুকুটহীন সম্রাট। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজে গাড়ি চালিয়ে কলকাতার অলিতে-গলিতে দাঙ্গাবিরোধী মিশন নিয়ে, তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন। এই সাহসিকতায় বিমুগ্ধ হয়ে মহাত্মা গান্ধী দাঙ্গাকবলিত নোয়াখালীতে তাকে সফরসঙ্গী করেন।

🟡 হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দূরদর্শিতা ছিল- অনন্যসাধারণ। প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞান ও প্রদীপ্ত অভিজ্ঞতা তাকে তাৎক্ষণিকভাবে সক্রিয় করে তোলে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে একটি জনসংগঠন গড়ে তোলার জন্য। দ্বিজাতিতত্ত্ব ও ১৯৪৭ সালে জিন্নাহর গগণচুম্বী জনপ্রিয়তা এবং নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে তিনি উপলব্ধি করতে ভুল করেননি বলেই তার নিজের হাতে গড়া প্রথম সংগঠনটির নাম হয়- জিন্নাহ মুসলিম লীগ। পরে এটা আওয়ামী মুসলিম লীগে রূপান্তরিত হয়…

🟡 উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, গণতন্ত্রের মানসপুত্র, অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান” এর রাজনৈতিক অভিভাবক »হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী’র ৬০ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা💐

#Huseyn_Shaheed_Suhrawardy
#হোসেন_শহীদ_সোহরাওয়ার্দী
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী

লেখা-Nur Novi


শেয়ার করুন

0Shares

আরও খবর

Sponsered content