প্রতিনিধি ৪ ডিসেম্বর ২০২৩ , ১২:০১:১৯
১৯১১ সাল। ইতালির ” জ্যানেটি” নামক এক কোম্পানি ঘোষণা করল তারা তাদের নতুন একটি ট্রেন লঞ্চ করতে চলেছে। যেটার প্রথম সফরে যাত্রীদের দেওয়া হবে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে যাত্রার সুযোগ। সেকালের হিসেবে ট্রেনটির সাজ সরঞ্জাম, খাবার দাবার ছিল যথেষ্টই লোভনীয়। বেশ আকর্ষণীয় সুযোগই বলতে হয়। ফলে অনেকেই প্রথম সফরে যাওয়ার আর্জি জানালেন। শেষমেশ সফরের দিন দেখা গেল গাড়ির চালক মিলিয়ে মোট ১০৬ জন যাত্রী ট্রেনটিতে যাত্রা করছেন।
গ্রীষ্মের সকালে মোট ১০৬ জন যাত্রী নিয়ে সেই ” জ্যানেটি ” ট্রেন তার যাত্রা শুরু করল। সব ঠিকই ছিল। ট্রেন চলছিল নিয়মমাফিক। যাত্রীরা বেজায় খুশি। সকলেই গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত চুটিয়ে উপভোগ করছেন এই ট্রেন জার্নি। এমন সময়ই ট্রেনটি এসে পৌছাল লম্বারডি পাহাড়ের কাছাকাছি। এই পাহাড়ের পেটের ভিতর দিয়ে একটি অন্ধকার টানেল। এই টানেল পার করেই ট্রেনটিকে পৌঁছতে হবে গন্তব্যে। যদিও টানেলে ঢোকার আগে সেই ট্রেনের যাত্রীরা ভাবতেও পারেনি তাদের সঙ্গে কি ঘটতে চলেছে।
১৯১১ সালের গ্রীষ্মের দুপুর। ট্রেনটি ১০৬ জন যাত্রী নিয়ে সেই টানেলে ঢোকে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে আর বেরোয় না। একদমই তাই! আর বেরোয় না! সেই যে ট্রেনটি টানেলে ঢোকে তারপর তার আর কোনো ট্রেস পাওয়া যায় না। ঠিক যেন তার সমস্ত যাত্রীকে নিয়ে একবারে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে ট্রেনটি। বহু মানুষই আগের স্টেশন থেকে ট্রেনটিকে ছাড়তে দেখেছে। কেউ কেউ আবার সেই টানেলেও ঢুকতে দেখেছে ট্রেনটাকে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ট্রেনটাকে টানেল থেকে বেরোতে কেউ দেখেনি। কেউ না !
এরপর বিস্তর খোঁজা খুঁজি। টানেল তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। অত বড় ট্রেন অথচ কোথাও কোনো চিহ্ন মাত্র নেই। শেষমেশ খোঁজ মিলল ওই ট্রেনেরই দুইজন যাত্রীর। দুজনেই যেন মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত। দুজনেই কোনো কথা বলতে চায় না। বহু জিজ্ঞাসাবাদের পর দুজন মুখ খুলল। এবং যে কাহিনী তারা শোনাল তা যেন গল্পের চেয়েও বিস্ময়কর।
ট্রেনটি যখন টানেলে প্রবেশ করে তখনও পর্যন্ত সব নাকি ঠিক ছিল। কিন্তু টানেলের মাঝামাঝি আসতেই একটা অদ্ভুত সাদা কুয়াশা নাকি পুরো ট্রেনটাকে ঘিরে ধরে। সেই অদ্ভুত কুয়াশায় ট্রেনের যাত্রীদের সকলেরই দমবন্ধ হয়ে আসে। সকলেই ছটফট করতে থাকে। সারা ট্রেন জুড়ে হইচই পড়ে যায়। ভয়ে, আতঙ্কে যাত্রীরা প্রাণপণ চিৎকার করতে থাকে সাহায্যের জন্য। ঠিক সেই সময়ে, একদম শেষ মুহূর্তে এই দুজন যাত্রী ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেয় বাইরে। এরপর অদ্ভুতভাবেই তাদের চোখের সামনে ট্রেনটি মিলিয়ে যায় টানেলের ভিতরকার ঘন সাদাটে কুয়াশার মধ্যে। ব্যাস তারপর তাদের আর কিছু মনে পড়ে না।
“জ্যানেটি” ট্রেনের এই আচমকা উধাও হয়ে যাওয়া সেইসময় বেশ সাড়া ফেলে দেয়। বহু নিউজ পেপারে এ নিয়ে বড় বড় আর্টিকেল ছাপা হয়। রহস্য আরও ঘনীভূত হয়ে ওঠে। যদিও বহু অনুসন্ধানের পরেও রহস্যের কিন্তু কোনো সমাধান হল না। সময় যত যায়, মানুষের স্মৃতিও ফিকে হতে থাকে। একসময় জ্যানেটি ট্রেনের কথা সকলে যখন ভুলেই গেছে তখনই আবারও একবার চর্চায় উঠে আসে সেই ট্রেন। অদ্ভুতভাবে এই বার আরও চমকপ্রদ কাহিনী নিয়ে।
সেই দিন ওই ট্রেনে যতজন যাত্রী মিসিং হয়ে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যেই এক যাত্রীর এক রিলেটিভ কেসটা নিয়ে বিস্তর রিসার্চ করছিল। বিভিন্ন রেকর্ড ঘটতে গিয়ে ১৯২৬ সালে সে আচমকা একটা অদ্ভুত তথ্য আবিষ্কার করে। মেক্সিকোতে নাকি আচমকাই ১০৪ জন যাত্রী উপস্থিত হয়েছে যাদের দাবি তারা ইতালি থেকে ট্রেনে করে এসেছে। অদ্ভুতভাবে তারা যে ট্রেনটির বর্ণনা দেয় সেটি হুবহু মিলে যায় “জ্যানেটি” ট্রেনের সঙ্গে। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর যা, তা হল এই রেকর্ডটি ১৮৪৫ সালে! আজ্ঞে হ্যাঁ ১৮৪৫। যে ট্রেন ছেড়েছেই ১৯১১ সালে, সেই ১৮৪৫ সালে যাত্রীদের নিয়ে পৌছাল কি করে?
পুরোনো সেই রেকর্ডটি ঘাটলে আরও বিস্ময়কর তথ্য সামনে উঠে আসে। ওই ১০৪ জন যাত্রীকে ওই সময় মেক্সিকোর এক সাইকিয়াট্রিক হসপিটালে রাখা হয়েছিল। সেই হাসপাতালে গিয়ে ক্রসচেক করলে দেখা যায় ঘটনাটা হুবহু সত্যিই। সেই ১০৪ জনের প্রত্যেকেই নাকি মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত ছিল। তারা কেবল দাবি করত তারা রোমে ফিরে যেতে চায়। একটা অদ্ভুত ট্রেনে করে ঘন কুয়াশাময় টানেলের ভিতর দিয়ে তারা নাকি এখানে এসে পৌঁছেছে।
এমনকি সেই হসপিটালের রেকর্ড অনুযায়ী ওই ১০৪ জনের পোশাকও ছিল সেকালের তুলনায় সম্পূর্ণ অন্যরকম। শুধু তাই নয়, তাদের মধ্যে একজন প্যাসেঞ্জারের কাছে ছিল একটা তামাকের পাত্র যার গায়ে খোদাই করে লেখা আছে ”১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ”। এই তামাকের পাত্রটি হসপিটাল অথরিটি যত্ন করে রেখেছিল এই অদ্ভুত ঘটনার স্মৃতি হিসেবে। এটি এখনও মেক্সিকোতে সংরক্ষিত আছে।
এরপর থেকেই এই অদ্ভুত ট্রেনের কাহিনী দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন জার্মান, ফ্রান্স, ইতালি বিভিন্ন সময় দাবি করতে থাকে এরকম একটি অদ্ভুত ট্রেন নাকি তাদের দেশেও দেখা গিয়েছে। কখনও সেটা ১৯৫৫ সাল তো কখনও আবার ১৯৭১! এমনকি এও শোনা যায় যে ১৯৯১ সালে পোলটাভায় এক প্যারানরমাল রিসার্চার এই ট্রেনটির সামনে ঝাঁপ দিয়ে চিরতরে নিখোঁজ হয়ে যান।
ঠিক কি হয়েছিল ১৯১১ সালের সেই দুপুরে? কিভাবে ট্রেনটি হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল টানেলের মধ্যে দিয়ে? কিভাবেই বা সেটা পৌছাল প্রায় সত্তর বছর আগের মেক্সিকোয়? এ সকল প্রশ্নের উত্তরই ধোঁয়াশাময়। অনেকেরই ধারণা ট্রেনটি কোনোভাবে টাইম ট্রাভেল করে অতীতে চলে গিয়েছিল আবার অনেকের মতে ট্রেনটি হয়তো ছিল কোনো গোপন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার অংশ। কেউ কেউ মনে করেন এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কোনো এক্সট্রাটেরিস্টিয়াল লিংক। এলিয়েন ইন্টারাপশন।
যদিও এ সকলই থিওরি। আসলে যে কি ঘটেছিল তা কেউ জানে না। আসলে আমাদের মহাবিশ্বে এমন অনেক ঘটনাই ঘটে যার কারণ জানা হয়তো সম্ভবও নয়! এটাও হয়তো সেরকমই কোনো ঘটনা। তবুও এই আশ্চর্য রহস্যময় ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যার শেষ নেই। অনেকের মতে আবার ঘটনাটি নিছকই একটি জনপ্রিয় আরবান লেজেন্ড ছাড়া কিছুই নয়।
তবে ধরে নিই যদি ঘটনাটি সত্যি তাহলে সেদিন ঠিক কি ঘটে থাকতে পারে ট্রেনটির সঙ্গে? এই ব্যাপারে পাঠকদের কি মতামত। জানার অপেক্ষায় রইলাম।
( #কল্পলতিকা_এক্সপ্রেস সিরিজের একদম প্রথম দিকের লেখা এটি। ফেসবুক সেই স্মৃতি ফিরিয়ে দিল। তাই আবার পোস্ট করলাম যারা পড়েননি তাদের জন্য। নিছক আরবান লেজেন্ড হলেও এই কাহিনী গল্প হিসেবে পড়তে মন্দ লাগে না। তাই আবারও পোস্ট করলাম। ও হ্যাঁ খুব শিগগিরই কল্পলতিকা এক্সপ্রেসের নতুন গল্প নিয়ে হাজির হচ্ছি! )