সারাদেশ

নির্বাচন শেষে শতাধিক সংঘর্ষ, এলাকাছাড়া কয়েক হাজার

  প্রতিনিধি ১২ জানুয়ারি ২০২৪ , ১০:২০:৪০

শেয়ার করুন

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গত পাঁচ দিনে শতাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে তিনজন। আহত দুই শতাধিক। ১৫০টির বেশি বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কয়েক হাজার মানুষ। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা চলমান পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। এর মধ্যে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) নামের একটি মানবাধিকার সংস্থা এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, নির্বাচন-পরবর্তী হামলার ঘটনায় নৌকার প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে ভাঙচুরের অভিযোগ বেশি পাওয়া যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে, বেশির ভাগ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে নৌকার প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে। এতে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি টাকা, গবাদি পশুসহ আসবাব লুটপাট হয়েছে। এমনকি ফসলেরও ক্ষতি করা হয়েছে। এসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণে জেলা পুলিশ সুপারদের কঠোর ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।

পুলিশ সূত্র জানায়, এবারের নির্বাচনে অন্তত ২২০টি আসনে সাড়ে তিন শর বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোটের মাঠে ছিলেন। ৬২টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। এসব এলাকায় প্রত্যাশা অনুযায়ী ভোট না পেয়ে পরাজয়ের পর প্রতিপক্ষ এ হামলা চালাচ্ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচন ঘিরে ১৮ থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ দিনে হামলা, সংঘর্ষ, নাশকতা ও ভাঙচুরের ঘটনায় দেশের বিভিন্ন থানায় ১৮৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

নির্বাচন-পরবর্তী হামলার ঘটনায়ও সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা হয়েছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচন-পরবর্তী আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে কয়েকটি থানার ওসিকে সতর্ক করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে বলা হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি-অপারেশন) আনোয়ার হোসেন বলেন, নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা, হামলা, ভাঙচুর নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সতর্ক রয়েছে। যেখানেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে, পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করছে।

ঝিনাইদহের পোড়াহাটিতে সবচেয়ে বেশি হামলার ঘটনা ঘটে। সেখানে অন্তত ৪০টি বাড়িতে হামলা চালানো হয়। এর বাইরে মাদারীপুরের কালকিনিতে ৪৫টি, সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে ২০টির বেশি দোকান, বসতবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া পিরোজপুরের ইন্দুরকানি, নেত্রকোনার কেন্দুয়া, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, গাজীপুর, গাইবান্ধা, খুলনার ডুমুরিয়া, নাটোর, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, ঢাকার ধামরাই, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, খোকসা ও কুমারখালী, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান, পটুয়াখালীর কলাপাড়া, রাজশাহীর পবা, পারিলাসহ দেশের বিভিন্ন আসনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বেশি সংঘর্ষ হয়েছে।

সর্বশেষ মাদারীপুর-৩ আসনে (কালকিনি-ডাসার-সদরের একাংশ) ঈগল প্রতীকের প্রার্থীর বিজয় মিছিলে বোমা হামলায় এমারত সর্দার (৪৫) নামের এক চা দোকানি নিহত হন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি। তাঁর স্ত্রী, দুই ছেলে ও বাবা রয়েছেন।

গত বুধবার সাভার পৌর এলাকার কাতলাপুরে নৌকা ও ঈগলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ১০ জন আহত হয়। বাড়িঘরে হামলার শিকার লোকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও প্রস্তাবিত উপজেলা কমিটির স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রশিদ দুলালের সমর্থক। তিনি অভিযোগ করেন, নির্বাচনের পর পাবনা-১ আসনের বিভিন্ন এলাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর লোকজনের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে।

 

এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুষ্টিয়া-৪ আসনের খোকসায় নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা রূপ নিয়েছে চরমে। সর্বশেষ নৌকা ও ট্রাক প্রতীকের সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা হয়েছে। এ ঘটনায় নৌকার চারটি বাড়ি ভাঙচুর, গরু ও টাকা লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ ঘটনা ছাড়াও গত চার দিনে খোকসা থানায় তিনটি মামলা রেকর্ড হয়েছে। পুলিশ এসব মামলায় এরই মধ্যে চারজনকে আটক করেছে।

নৌকার সমর্থক জয়ন্তীহাজরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সাকিব খান টিপু এবং সদ্যোবিজয়ী ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক আরিফুল ইসলাম নয়ন গ্রুপ নির্বাচনের দিন থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে পাঁচবার পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এই সময়ে থানায় তিনটি মামলাও তালিকাভুক্ত হয়েছে।

গত বুধবার রাত ৮টার দিকে খোকসার জয়ন্তীহাজরা ইউনিয়নের উথলী ও রাধানগর গ্রামে মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দিয়ে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটে। টিপু ও আরিফুল ইসলাম নয়নের দুই গ্রুপ এ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।

খোকসা থানার ওসি আননুর জায়েদ জানান, রাধানগর ও উথলী গ্রামে পর পর কয়েকটি হামলার ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত চারজনকে আটক করা হয়েছে।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় নির্বাচনী প্রচারণায় সংঘর্ষে জাহাঙ্গীর আলম (৫৫) নামের স্বতন্ত্র প্রার্থীর এক সমর্থক নিহত হয়েছেন। নিহত জাহাঙ্গীরের ভাই আলমগীর হোসেন বলেন, ‘পিরোজপুর-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফ আলীর সমর্থনে নির্বাচনী প্রচারণায় যান আমার ভাই। এ সময় ঈগল প্রতীকের বশির ফরাজীর লোকজন দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের ওপর হামলা চালায়। এতে আমার ভাই গুরুতর আহত হন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।’

 

নির্বাচনী সহিংসতায় ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে আন্তত ২৫ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন যাত্রাবাড়ীর সায়দাবাদে ককটেল বিস্ফোরণে আহত আনসার ভিডিপি সদস্য অন্তর, নারায়ণগঞ্জ আড়াইহাজার থেকে গুলিতে আহত আব্দুর নূর, সাকিব, কামাল ও সায়মন।

এ ছাড়া হাজারীবাগে ককটেলের আঘাতে আহত আমির হোসেন, তানভীর, মাকসুদা বেগম ও বাদল মিয়া, নরসিংদী থেকে ছুরিকাঘাত মো. খলিল, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ চৌরাস্তা থেকে মাথায় আঘাতে আহত বাসেদ সরকার, কিশোরগঞ্জ শ্রীনগর ভৈরব বন্দুনগর সরকারি প্রামিক বিদ্যালয় থেকে বল্লমের আঘাতে আহত কিবলু মিয়া রয়েছে।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, নির্বাচনী এলাকায় ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী হিসেবে পেশিশক্তি প্রদর্শন ও সহিংসতা করার পরিকল্পনা যারা করছে তাদের এরই মধ্যে গোয়েন্দা নজরদারিতে আনা হয়েছে।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, নির্বাচন-পরবর্তী হামলা, ভাঙচুর, সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে গোয়েন্দা কার্যক্রমের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।


শেয়ার করুন

আরও খবর

Sponsered content