প্রতিনিধি ২১ জানুয়ারি ২০২৪ , ১০:৩৩:০৪
বাংলাদেশে কারা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা কমছে না। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সমালোচনার পরও ২০২৩ সালে কারা হেফাজতে রেকর্ড ১০৬ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে শুধু নভেম্বরেই মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের।
সম্প্রতি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়েছে, গত বছর কারা হেফাজতে ৬ বিএনপি নেতাসহ বিচারাধীন মামলার ৬৪ জন আসামি এবং দণ্ডিত ৪২ জন আসামি মৃত্যুবরণ করেছেন। আর ২০২২ সালে কারা হেফাজতে বিচারাধীন মামলার ৩৭ ও দণ্ডিত ২৮ জনসহ ৬৫ জন মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
আসক জানিয়েছে, গত ৫ বছরে কারা হেফাজতে ৩৮৫ জন মারা গেছেন। ২০২১ সালে দণ্ডিত ৫২ ও বিচারাধীন মামলার ২৯ জনসহ ৮১ জন, ২০২০ সালে দণ্ডিত ৩০ ও বিচারাধীন মামলার ৪৫ জনসহ ৭৫ জন এবং ২০১৯ সালে দণ্ডিত ৪২ ও বিচারাধীন মামলার ৩৬ জনসহ ৫৮ জন মারা গেছেন।
সবশেষ গত ১৪ জানুয়ারি চাঁদপুর কারাগারে বিচারাধীন হত্যা মামলার আসামি ব্রজলাল পাটিকর মারা যান। হাসপাতালে নেয়ার আগেই তিনি মারা যান বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।
মানবাধিকার সংগঠনটির হিসেবে, পাঁচ বছরের মধ্যে ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি ১০৬ জন কারা হেফাজতে মারা গেছেন। আর বিভাগ হিসেবে সবচেয়ে বেশি ৭১ জনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকায়।
গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দি ইদ্রিস আলী মোল্লা (৬২) অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। তার মৃত্যু সনদে বার্ধক্যজনিত কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। ২৬ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সৈয়দ মোছাব্বের হোসেন (৫২) নামে এক আসামির মৃত্যু হয়। তার মৃত্যু সনদে বলা হয়েছে, উচ্চরক্তচাপ ও দীর্ঘ দিন ধরে নানা ধরনের জটিল রোগে তার মৃত্যু হয়েছে। গত ১ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দি মফিজ বাবু (৬২) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। তার মৃত্যু সনদে মৃত্যুর কারণ হিসেবে একই ধরনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে গত বছরের ১১ আগস্ট একটি ডাকাতি মামলার আসামি আনোয়ার হোসেনের মৃত্যু হয়। কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয়েছে। তবে পরিবারের অভিযোগ, গ্রেফতারের পর পুলিশি নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে কারাগারে মারা গেছেন আনোয়ার। গত ৪ সেপ্টেম্বর মেহেরপুর কারাগারে জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি তোফায়েল আহমেদের মৃত্যু হয়। কারা কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু হয় তার।
সূত্রমতে, ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার লেখক মুশতাক আহমেদ ১০ মাস কারাবন্দি থাকা অবস্থায় গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে মারা যান। শহীদ তাজ উদ্দিন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ মর্গে তার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গত বছরের ১৩ মার্চ বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে হাজতি জহিরুল মারা গেলে অসুস্থতার কথা বলে কারা কর্তৃপক্ষ। তবে তার বড় ভাই আলী আকবর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পিবিআইয়ের লোকজন জহিরুলকে গ্রেফতারের পর আদালতে না দিয়ে ব্যাপক মারধর করলে কারাগারে মারা যান তিনি। মারা যাওয়ার চার-পাঁচ দিন আগে কারাগারের মধ্যে কিছু লোক জোড় করে তার ঘাড়ে ইনজেকশন দেয় বলেও পরিবারকে জানিয়েছিল জহিরুল।’ ২০১৯ সালে পঞ্চগড় জেলা কারাগারে আইনজীবী পলাশ কুমার রায় আগুনে পুড়ে মারা গেলে কর্তৃপক্ষ আত্মহত্যা বলে জানায়। ঐ সময় তার পরিবার আত্মহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে।
কারা সূত্র জানায়, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ফজর আলী ও ৩০ আগস্ট খোকা মিয়া নামের দুই বন্দি নরসিংদী কারাগারে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এই দুইটি ঘটনায় নিচের পদের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও কারাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন বলেন, বিচারে দীর্ঘসূত্রতায় মানসিক চাপ, আন্তঃসামাজিক মর্যাদাগত চাপ ও ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ বন্দি, রাতের বেলা হার্ট অ্যাটাকসহ অন্যান্য গুরুতর অসুখে তাৎক্ষণিক ও যথাসময়ে চিকিৎসা না পাওয়াই কারাগারে বন্দি মৃত্যুর কারণ। এছাড়া গ্রেফতারের পর থানা হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের যে পদ্ধতি অর্থাৎ মারধর বা নির্যাতনের কারণে অনেকের মৃত্যু হয়। অথচ বন্দি মৃত্যু নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ সব সময় গতবাধা কথা বলে। তারা ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ অথবা ‘হার্ট অ্যাটাক’-এর কথা বলে থাকে। কারা হেফাজতে মারা যাক, আর পুলিশ হেফাজতে মারা যাক—এসব মৃত্যুর ঘটনায় ময়নাতদন্ত বাধ্যতামূলক এবং একটি কমিটি গঠন করে ময়নাতদন্ত করতে হবে। এই মানবাধিকার সংগঠক আরও বলেন, কারাগারে একজন সাধারণ বন্দি অসুস্থ হলে প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন আমলে নেওয়া হয় না। যখন চূড়ান্ত অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। এছাড়া প্রকৃত অসুস্থ রোগীরা হাসপাতালে জায়গা পায় না। এখানে যার টাকা আছে, তারা সহজেই চিকিৎসা সেবা পায়।