প্রতিনিধি ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ , ৭:৫১:৪৯
কা’বা শরীফ সর্ব প্রথম নির্মান করেন হযরত ইব্রাহীম খলীলুল্লাহ। কোন সহীহ হাদীস দ্ধারা প্রমান করা যায় নি যে, এর পূর্বে কেউ কাবা শরীফ নির্মান করেছিল। আপনি যদি সুরা হাজ্জের ২৬-২৭ নাম্বার আয়াত দেখেন সেখানে পরিস্কার লেখা আছে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইব্রাহীমের (অঃ) এর জন্য সেই ঘরের (কাবা) স্থান নির্ধারন করে দিয়েছিল। এখানে অনেকেই দ্বিমত পোষন করেন, কেউ কেউ বলেন হযরত আদম (অঃ) থেকে এই ঘরের স্থান নির্ধারিত, নুহ নবীর কিস্তি এই ঘর কে কেন্দ্র করে ৪০ দিন ঘুরছিলো অথবা তারো আগে ফেরেশতারা তাওয়াফ করেছিলো। কিন্তু এগুলো কোরান হাদীস দ্ধারা বর্নিত না, মুলতঃ এগুলো তাওরাত বা ওল্ড টেষ্টামেন্ট দ্ধারা গৃহীত।
কাবা ঘর তৈরীর সময় যখন এটি উচু হয়ে উঠল তখন ইব্রাহীম (অঃ) এর পুত্র হযরত হযরত ঈসমাইল (আঃ) এক খন্ড পাথর এনে দিল তার পিতাকে এর ওপর দাড়িয়ে কাবা ঘর নির্মানের জন্য। আল্লাহর কুদরতের সাক্ষী হিসাবে ইব্রাহীম (আঃ) নগ্নপদ চিহ্ন অঙ্কিত সেই পাথর কাবা সংলগ্ন স্থানে এখনো বিদ্যমান যা মাকামে ইব্রাহীম নামে পরিচিত। এই মাকামে ইব্রাহীম হযরত উমর (রাঃ) এর শাসনামল পর্যন্ত কাবা শরীফের সাথেই ছিল, পরে তাওয়াফের সুবিধার জন্য উমর (রাঃ) মাকামে ইব্রাহিম কাবা থেকে সামান্য কিছুটা দূরে এনে স্থাপন করেন, যা এখনো বর্তমান। কাবার ইতিহাস অনেক বিস্তৃত তা এখানে আলোচনার স্থান নেই। কেউ ইন্টারেষ্টেড হলে ইবনে কাসিরের আল বিদায়া ওয়া নিহানা র প্রথম খন্ডের ৩৬৭-৩৭৩ পৃষ্টা থেকে পড়ে দেখতে পারেন।
এখন আমরা যাব একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে, মহানবী (সাঃ) তার জীবদ্দশায় কতবার হজ্জ করেছেন?
হিজরতের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি মাত্র হজ্ব করেছেন। সেটি হল বিদায় হজ।
বিদায় হজ দশম হিজরিতে হয়েছে। হিজরতের আগে কয়টি হজ করেছেন এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা বলা যায় না। জামে তিরমিজির এক বর্ণনায় দুইটির কথা আছে। তবে অন্যান্য দলীল দ্বারা তাবেয়ীন ও মুহাদ্দিসগণ আরো বেশি সংখ্যক হজের কথা উল্লেখ করেছেন।
ইবনুল আমির (রাহ) বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরতের আগে প্রতি বছরই হজ করতেন। এটাই স্বাভাবিক। এর সঠিক সংখ্যা আল্লাহতালাই ভালো জানেন।
মহামারীর কারনে বর্তমানে অত্যান্ত স্বল্প পরিসরে হজ এবং ওমরাহ হজ পালিত হচ্ছে, চলুন দেখা যাক ইতিহাসে কি এমন ঘটনা ঘটেছিল?
কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে ৬৩ হিজরিতে। ইমাম হোসাইন (রা.) কে হত্যা করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে নেয় ইয়াজিদ। ক্ষমতার শুরু থেকেই মক্কা-মদিনায় নির্মম গণহত্যা চালাতে থাকে পাপীষ্ঠ ইয়াজিদ। এর ঠিক দশ বছর পর ৭৩ হিজরি অর্থাৎ ৬৯৩ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ানের নির্দেশে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বাইতুল্লাহ অবরোধ করে বসে।
সেখানে হজরত আবু বকর (রা.)-এর নাতি হজরত আসমা (রা.)-এর ছেলে আবদুল্লাহ বিন জোবায়ের (রা.) আত্মগোপন করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন ন্যায়নিষ্ঠ সাহাবি। জালেম শাসকদের সামনে বিরোচিতভাবে সত্য উচ্চারণ করার অপরাধে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পাপীষ্ঠ মারওয়ান যখন জানতে পারল ন্যায়নিষ্ঠ এ সাহাবি কাবা শরিফে আত্মগোপন করে আছেন, তখন তাকে গ্রেফতার করার জন্য কাবাঘরে সাময়িক সময়ের জন্য তাওয়াফ এবং উমরাহ হজের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। শুধু তাই নয়, মারওয়ান কাবা শরিফের একাংশ ভেঙে ফেলে শুধু এ জন্য যে, ওই অংশ নির্মাণ করেছিলেন মজলুম সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জোবায়ের (রা.)।
ইরাকের আব্বাসি শাসক ও মিসরে উবায়াদি শাসকদের দুর্বলতার সুযোগে কারামিয়া শাসকরা আরব উপদ্বীপের পূর্ব দিকে বাহরাইনে একটি রাষ্ট্র গঠন করে। তাদের বিশ্বাস ছিল, ‘হজ জাহেলি যুগের একটি নিদর্শন। হজ অনেকটা মূর্তি পূজার মতোই।’
তাই ইসলামের ফরজ বিধান হজ বন্ধ করতে কারামিয়া শাসকরা তৎপর হয়ে ওঠে। ৩১৭ হিজরি ৯৩০ খ্রিস্টাব্দ ছিল মুসলমানদের বেদনাদায়ক ইতিহাস। বাহরাইনের শাসক আবু তাহের কারামিয়া নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী হাজিদের কাফেলায় আক্রমণ করে। অনেক নারী-পুরুষকে হত্যা করে এবং তাদের সম্পদ ছিনতাই করে। ইরাক ও সিরিয়া থেকে মক্কা আসার পথে তারা আতঙ্ক তৈরি করে। ফলে ৩১৭ হিজরি থেকে ৩২৭ হিজরি পর্যন্ত মোট দশ বছর হজের কার্যক্রম বন্ধ ছিল।
প্রখ্যাত মুসলিম জ্ঞানী এবং ঐতিহাসিক আল্লামা ইমাদুদ্দিন ইবনে কাসির (রহ.) আল বিদায়া ওয়ান নেহায়ায় লেখেন, ৩৫৭ হিজরিতে মক্কায় মাশিরি নামের একটি রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় হাজীদের বেশিরভাগ লোকই ওই রোগে মৃত্যুবরণ করেন। কেউ কেউ মক্কায় আসার পথে পিপাসায় কাতর হয়ে মারা যান। আর অনেকে হজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে মারা যান।
ইমাম ইবনে জাওজি (রহ.) আল মুনতাজা গ্রন্থে লেখেন, ৩৭২ হিজরিতে আব্বাসি খলিফা ও মিসরের উবাইদি শাসনের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়। ফলে ৩৭২ থেকে ৩৮০ হিজরি পর্যন্ত মোট আট বছর ইরাকের কেউ হজ করতে পারেনি। ৪১৭ হিজরিতে মিসর ও প্রাচ্যের কারও পক্ষে হজ করা সম্ভব হয়নি।
৪২১ হিজরিতে ইরাক ছাড়া অন্যরা হজে অংশ নিতে পারেন। ৪৩০ হিজরিতে ইরাক, খোরাসান, শাম ও মিসরের কেউ হজ করতে পারেনি। কারণ এ সময় দাজলা নদীসহ অন্যান্য বড় নদীর পানি বরফে পরিণত হয়। ফলে মানুষজনের চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ে।
৪৯২ হিজরিতে মুসলিম বিশ্বের শাসকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘাত দেখা দেয়। এতে মক্কায় যাওয়ার পথ অনিরাপদ হয়ে পড়ে। ফিলিস্তিনের বাইতুল মোকাদ্দাস খ্রিস্টানদের দখলে যাওয়ার পাঁচ বছর আগে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ১০৩৮ হিজরি ১৬২৯ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় ব্যাপক বন্যা হয়।
ফলে কাবার দেয়াল ভেঙে পড়ে। সুলতান চতুর্থ মুরাদের নির্দেশে কাবা পুনর্নির্মাণের সময় হজ ও ওমরাহর কার্যক্রম বন্ধ থাকে। ১২১৩ হিজরিতে ফরাসিদের আক্রমণের ফলে নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ফলে ওই বছর হজও বন্ধ থাকে। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে তিন-চতুর্থাংশ হাজী মারা যায়। এ ছাড়া আরও কিছু মহামারীর কারণে ১৮৩৭ থেকে ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘদিন মক্কায় হাজীদের আগমন বন্ধ থাকে।
রেফারেন্সঃ আল বিদায়া ওয়া নিহানা এবং অন লাইনে বিভিন্ন সুত্র
লেখক-শোভন রেজাউনুল হক