কাজের সুবাদে স্বামী বাড়ির বাইরে অবস্থান করায় ১২ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে ঘুমাচ্ছিলেন এক নারী। গভীর রাতে ঘরের সিঁধ কেটে ওই ঘরে তিনজন ব্যক্তি প্রবেশ করে তাদের হাত মুখ বেঁধে ফেলে। পরে ওই নারী দলবদ্ধ ও তার মেয়ে একক ধর্ষণের শিকার হন। যারা তাদের ঘরে প্রবেশ করে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের দুজনকে ভুক্তভোগী নারী চিনতে পারেন। তাদের একজন সাবেক ইউপি সদস্য ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা। নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায় গত ৫ই ফেব্রুয়ারি ঘটনাটি ঘটে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে ফের ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতেও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া একই ঘরে মা-মেয়েকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। শিশু-বৃদ্ধও ধর্ষণকারীদের কাছ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। ধর্ষণের পর কিছু নারী শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে।
লোকলজ্জার ভয়ে অনেক নারী আত্মহত্যারও পথ বেছে নিচ্ছেন। একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্যমতে জানুয়ারি মাসে ২৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। চলতি মাসে এই সংখ্যাটা আরও বেশি হবে। কারণ ইতিমধ্যে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। তবে সংখ্যাগতভাবে যে পরিমাণ ঘটনার হিসাব সামনে আসে প্রকৃতপক্ষে এরচেয়ে বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, দেশে যে পরিমাণ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তার প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। কারণ সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে, থানা-পুলিশ আইন আদালতে ঝক্কি-ঝামেলা হবে এরকম চিন্তা থেকে অনেক ভুক্তভোগী নারীই মামলা করতে চান না। সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, নৈতিক অবক্ষয়, মাদকতা, বিচারহীনতা, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবের কারণে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে। অধিকাংশ ধর্ষণের ঘটনায় প্রভাবশালীরা জড়িত। তারা ঘটনার পর ভুক্তভোগী ও তার পরিবারকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে এবং প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে এ ধরনের ঘটনা থেকে রেহাই পেয়ে যান।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে ২০১৯ সালে সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৪১৩টি। ওই বছর ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে ৭৬টি। আর ধর্ষণচেষ্টা করা হয়েছে ২২৪ জনকে। এসব ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে ৯৯৯টি। ২০২০ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৬২৭টি। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৫৩ জন। ৩২৬ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ১ হাজার ১৪০টি ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। ২০২১ সালে ১ হাজার ২৩১টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ৪৭ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ২৯৩ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। থানায় মামলা হয়েছে ৯১৬টি। ২০২২ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৩৬টি। ৪৭ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ১৫৮ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। থানায় মামলা হয়েছে ৬৫৯টি। ২০২৩ সালে ধর্ষণের ঘটনা কমেছে। ওই বছর ৫৪৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ৩৩ জন ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন। আর ১২৯ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ৪৩৩টি ঘটনায় মামলা হয়েছে।
গত রোববার রাতে খুলনার পাইকগাছায় এক গৃহবধূর চোখে-মুখে আঠা লাগিয়ে এবং হাত-পা বেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে। গৃহবধূর স্বামী কাঁচামালের ব্যবসা করেন। ঘটনার রাতে তিনি বাড়ির বাইরে ছিলেন। পড়ালেখার জন্য ছেলে ও মেয়ে বাইরে থাকেন। এই সুযোগে দুর্বৃত্তরা ঘরের পাশের গাছ বেয়ে ছাদে উঠে ওই বাড়িতে ঢোকে। পরদিন সকালে ওই নারীর গোঙানির শব্দ শুনে প্রতিবেশীরা গিয়ে তাকে উদ্ধার করেন। এ সময় আঠা দিয়ে তার চোখ ও মুখ লাগানো ছিল। তার হাত ও পা বাঁধা ছিল। ঘটনার রাতে বাড়ি থেকে টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করা হয়েছে। ৩রা ফেব্রুয়ারি রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বামীকে ডেকে নিয়ে মারধর করে মীর মশাররফ হলের একটি কক্ষে আটকে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতাসহ বহিরাগত জড়িত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশে দলগত ধর্ষণের ঘটনা বহু আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। ধর্ষণের মতো আমলযোগ্য অপরাধ যখন অতীতে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হয় এবং বিচার প্রভাবিত করা হয় তখন ধর্ষণের মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তি এরূপ অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়। বিচার না হওয়া কিংবা বিলম্বিত হওয়া ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ। অধিকাংশ ধর্ষণের ঘটনা জানান দেয়- সমাজ প্রভাবশালী ও অশুভ ধারণা পোষণকারী ব্যক্তিরা নারীর স্বাভাবিক ও স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকারে বড় বাধা সৃষ্টি করছে। ধর্ষণের মতো জঘণ্য সমাজবিরোধী ঘটনার দ্রুত বিচার সম্পন্ন করাসহ সামাজিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ কার্যক্রমের মাধ্যমে নারীর জন্য নিরাপদ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব।
সম্পাদকঃ মাহবুবা আক্তার। অফিসঃ ৭৫ ই-ব্রডওয়ে,নিউইয়র্ক এনওয়াই ১০০০২।ফোন:+৮৮০১৭১২৯০৩৪০১ ই- মেইলঃ dailyhaquekotha@gmail.com
প্রকাশিত সংবাদপত্রের অংশ