বঙ্গবন্ধু ঘােষিত স্বাধীনতার বাণী যথারীতি চট্টগ্রামে পৌছায় এবং চট্টগ্রাম বেরতারের কর্মীরা তা ওয়ারলেসে ধারণ করেন। পাক বাহিনী ঢাকা বেতার তাৎক্ষণিক দখল করলেও চট্টগ্রাম বেতারটি আওয়ামী লীগ তথা স্বাধীনতাকামী কর্মীদের দখলে থাকে। সেখান থেকে যথারীতি অনুষ্ঠান চালু করা হয় এবং ২৬ শে মার্চ বেতারটির নাম দেয়া হয় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র, চট্টগ্রাম।
এই স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ শে মার্চ সকালের অধিবেশনে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতা জহুর হােসেন চৌধুরী, এম, আর, সিদ্দিকী প্রমুখের উপস্থিতিতে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হান্নান সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বাধীনতা ঘােষণার বাণী পড়ে শােনান। আব্দুল হান্নান তার ঐতিহাসিক ঘােষণীয় বলেনঃ
"স্বাধীন বাংলার সংগ্রামী ভাই ও বােনেরা!
সাড়ে সাতকোটি বাঙ্গালীর অবিসম্বাদিত মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন। গতরাতে বর্বর পাকবাহিনী অতর্কিতে বাংলার জনগণের ওপর মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইপিআর পুলিশ ছাত্র যুবকরা হাতিয়ার কেড়ে নিয়ে হানাদারদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছে। সারা বাংলাদেশে হানাদার বাহিনীকে নির্মূল করার জন্যে আমাদের দেশপ্রেমিক মুক্তিযােদ্ধারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছেন। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু মুক্তিবাহিনীকে পরিচালনা করছেন। তিনি আপনাদেরকে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর ওপর ঝাপিয়ে পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন।
আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। এই স্বাধীনতা যে কেনাে মূল্যের বিনিময়ে রক্ষা করতে হবে। গ্রামের লােকদের কাছে আবেদন, আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শহর অভিমুখে অগ্রসর হােন এবং পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মুক্তিযােদ্ধাদের সর্বোতভাবে সাহায্য করুন।
বন্ধুগণ! ঐ জালেম ইয়াহিয়ার হানাদারদের চিরতরে বিতাড়িত করার জন্যে এগিয়ে আসুন। আমরা সত্যের পথে আছি। জয় আমাদের হবেই। আমি সারা বিশ্বের কাছে, বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানাই, পাক বর্বর বাহিনীর নারকীয় হত্যাকান্ড দেখে চুপ করে থাকবেন না। এগিয়ে আসুন, সাড়ে সাতকোটি বাঙ্গালীকে সাহায্য করুন। মানবতার খাতিরে মানুষকে বাঁচাবার জন্যে, এদেশের মানুষের মুক্তিসংগ্রামে সাহায্য করুন।
পরিশেষে আমি আহবান জানাবাে, এই দেশ, এই জাতির মহান নেতা, সাড়ে সাতকোটি মানুষের দেবতা, বাংলার নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে পরিচালিত হােন, অন্য কারাে নির্দেশে নয়। বাঙ্গালী মার্শাল ল' মানে না, তারা স্বাধীনতা চায়। কোনাে আইনই আমরা মানি না। আমরা স্বাধীন বাংলার নাগরিক। স্বাধীন বাংলার নেতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশই আমাদের শিরােধার্য। জয় বাংলা। জয় স্বাধীন বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু !
উপরােক্ত ঘােষণা বাংলার টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত ইথারে ইথারে ভেসে গেল । বাংলার মানুষ হতভম্ব থেকে মুহুর্তমধ্যে চেতনাদৃপ্ত হলাে। স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে চারদিক থেকে বাঙ্গালী সৈন্য ইপিআর পুলিশ আনসার ছাত্র ও যুবকরা জনতার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হানাদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরােধ গড়ে তুললাে।
আব্দুল হান্নানের ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘােষণাপাঠ বিকেলের অধিবেশনেও কয়েকবার প্রচারিত হলাে। ঐ একই বেতার থেকে বিকেলে আবুল কাশেম সন্দ্বীপের কণ্ঠেও বঙ্গবন্ধু ঘােষিত স্বাধীনতার ঘােষণাপাঠ প্রচারিত হলাে। আবুল কাশেম সন্দ্বীপ এক ঘােষণায় বললেন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণায় উজ্জীবিত হয়ে বাঙ্গালী সৈন্যরা হানাদার বাহিনীর প্রশাসক জেনারেল টিক্কাখান ও তার ৫ জন সঙ্গীকে ঢাকায় হত্যা করেছেন। তাদেরকে গুলী করে হত্যা করেছেন একজন বাঙ্গালী কর্ণেল শামসুদ্দিন। অবশ্য কদিন পর জানা গেল, টিক্কাখান নিহত হননি, তার হাতে গুলী লেগেছিল। তবে টিক্কার কয়েকজন সঙ্গী নিহত হয়।
২৬ শে মার্চ রাত ৮টায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। রেডিও ও টেলিভিশনে প্রচারিত ভাষণে তিনি ঘােষণা করলেনঃ শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অনুগামীরা পাকিস্তানের শত্রু। শেখ মুজিব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেছেন। এই অপরাধের জন্যে শেখ মুজিবকে অবশ্যই কঠোর শাস্তি পেতে হবে। .......... দেশের সর্বত্র সকল রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করা হলাে এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে পুরােপুরি বাতিল করা হলাে।”
২৬ শে মার্চ রাত ১০টায় জেনারেল টিক্কাখান ঢাকা বেতারে ভাষণ দিলেন। মদপ্য টিক্কা দাঁতে দাঁত চেপে দান্তিককণ্ঠে ঘােষণা করলেনঃ হাম ইহাছে কই ইনসান নেহি চাইয়ে, হাম শ্রেফ মিট্টি চাইয়ে (আমি এখানে কোনাে মানুষ চাইনা, শুধু মাটি চাই)।
২৬ শে মার্চ বিবিসি লন্ডনের সান্ধ্যকালীন অধিবেশনে বলা হয়ঃ শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন বাংলাদেশ নামে ঘােষণা করেছেন, যা একটি গােপন বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছে।
২৬ শে মার্চ ভয়েস অব আমেরিকার (বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা) খবরে বলা হয়ঃ শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ঘােষণা দিয়েছেন, তিনি একটি গােপন রেডিও থেকে পূর্ব বাংলাকে 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ' বলে ঘােষণা দেন।
ঐ রাতে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, রেডিও অস্ট্রেলিয়া, আকাশবাণী, রেডিও মস্কো খবর দেয়ঃ পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘােষণা দিয়ে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা প্রদানের অভিযােগে বিচারের সম্মুখীন হবেন বলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এক বেতার ভাষণে উল্লেখ করেছেন।
২৭ শে মার্চ প্রত্যুষে ঢাকা বেতারের অধিবেশনের এক পর্যায়ে ইয়াহিয়া ও টিক্কার দাম্ভিক ঘােষণার জবাব দিলেন বেতারের এক ঘােষিকা নাজমা আখতার। রাতের অন্ধকারে পাক বাহিনী নাজমা আখতারকে তার বাসা থেকে ধরে নিয়ে আসে। বর্বর সৈন্যরা বেতারভবনে তার ওপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। এক পর্যায়ে নাজমা আখতার নিজেকে পাক সেনাদের সামনে একজন খাটি পাকিস্তানী হিসেবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। সৈন্যরা অতঃপর তাকে বেতারের ঘােষিকার দায়িত্ব অর্পণ করে। নাজমা পাকিস্তানী এক কর্ণেলের গাইডলাইন অনুযায়ী তােতাপাখির মতাে ঘােষণা দিচ্ছিলেন আর সুযােগ খুঁজছিলেন। সুযােগ তিনি নিজেই করে নিলেন। সকাল ৭টার খবর শেষে ইয়াহিয়া-টিক্কার ঘােষণা। পুনঃপ্রচারের পর শেখ মুজিব ও ভারতীয় চরদের বিরুদ্ধে একটি লিখিত কথিকা প্রচারের নাম করে বীরঙ্গনা নাজমা আখতার দৃপ্তকণ্ঠে ঘােষণা করলেনঃ বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্যে পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বর সৈন্যরা ব্যাপক গণহত্যায় লিপ্ত হয়েছে। বাংলার নেতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন। বাংলার মানুষ পাকবাহিনীর এ আঘাত ভুলবে না। ক্ষমা করবে না। তারা আজ আরাে রক্তপাত ও দুঃখ বরণের জন্যে প্রস্তুত। আমরা এ কোরবানী ব্যর্থ হতে দেবাে না। আপনারা শয়তানদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ুন, প্রতিশােধ নিন (সূত্রঃ 'ভারতরত্ন ইন্দিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কোলকাতা ১৯৭৪)।
বীরঙ্গনা নাজমার এই ঘােষণার পরপরই ঢাকা বেতার কেন্দ্র নীবর হয়ে গেল ।
কিছুক্ষণ পর ঘােষিত হলােঃ রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা। তারপরই শুরু হলাে অদ্ভুত সব পাকিস্তান মার্কা বাংলা গান, যুদ্ধের বাজনা আর জঙ্গী সামরিক বিধির ঘােষণা। পাকবাহিনী তাৎক্ষণিক বেয়নেট খুঁচিয়ে নাজমা আখতারকে নির্মমভাবে হত্যা করলাে। বীরঙ্গনা নাজমা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচারে অকাতরে নিজের জীবনদান করে গেলেন।
এদিকে ২৬ শে মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতার প্রচারের পর নিরাপত্তার কারণে বেতার কর্মীরা কালুর ঘাটের বেতার কেন্দ্রে চলে আসেন। বেলাল মােহাম্মদ ও তাঁর অন্যান্য সারথীরা ঐ রাতের মধ্যেই বেতার কেন্দ্রটি চালুর ব্যবস্থা করেন এবং ২৭ শে মার্চ সকাল বেলা অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করেন। এখানেও বিকেল পর্যন্ত আব্দুল হান্নান, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ ও আরাে কতিপয় বেতার কর্মী বঙ্গবন্ধু ঘােষিত স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেন ।
কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্রটিকে পাহারা দেবার ও কেন্দ্রটিকে নিরাপদ রাখার জন্যে অনেক খোঁজাখুঁজির পর বেলাল মােহাম্মদ ও তার সাথীরা পটিয়াতে গিয়ে মেজর জিয়ার সন্ধান পান। তারা মেজর জিয়াকে বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়ার জন্যে অনুরােধ জানালে তিনি সম্মত হন।
বেতার কেন্দ্রের অভ্যন্তরে ট্রান্সমিটার কক্ষে ঢুকে নিজের উপস্থিত বুদ্ধিতে বেলাল মােহাম্মদ মেজর জিয়াকে একটি ঘােষণা দেবার অনুরােধ জানালে তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হন। ঘােষণাপত্রটি ইংরেজীতে তৈরি করতে তাকে সাহায্য করেন বেলাল মােহাম্মদ ও তার অপর দু’সঙ্গী। ঘােষণাটি তৈরি হতে হতে ২৭ শে মার্চ সন্ধ্যা হয়ে আসে।
২৭ শে মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সান্ধ্য অধিবেশনে মেজর জিয়ার কণ্ঠে এই প্রথম ঘােষিত হলাে বঙ্গবন্ধুর নামে ঐতিহাসিক ঘােষণাপত্রটি। তাহলােঃ
The Government of the Sovereign State of Bangladesh, on behalf of our Great leader, the Supreme Commander of Bangladesh Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, We here by proclaim the independence of Bangladesh and that the Government headed by Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman has already been formed.
It is further proclaimed that Sheikh Mujibur Rahman is the sole leader of the elected representatives of Seventy Five Million people of Bangladesh and that the Government headed by him is only legitimate Government of the people of the independent Sovereign state of Bangladesh, which is legally and constitutionally formed and is worthy of being recognized by all the Governments of the world.
I therefore. appeal, on behalf of our Great leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, to the Governments of all the democratic countries of the World, specially the Big Powers and the neighboring countries to recognize the legal Government of the Bangladesh and take effective steps to stop immediately woeful genocide that has been carried on by the army of occupation from Pakistan.
To dub out the legally elected representatives of the majority of the people as secessionist is a crude joke and contradiction to truth which should befool none.
The guiding principle of the new state will be, first. neutrality, second, peace and third, friendship to all and enemity to none.
May Allah help us Joy Bangla
সূত্রঃ বঙ্গবন্ধু বিরোধী মিথ্যাচারঃ বাংলাদেশের রাজনীতি, আবির আহাদ
সম্পাদকঃ মাহবুবা আক্তার। অফিসঃ ৭৫ ই-ব্রডওয়ে,নিউইয়র্ক এনওয়াই ১০০০২।ফোন:+৮৮০১৭১২৯০৩৪০১ ই- মেইলঃ dailyhaquekotha@gmail.com
প্রকাশিত সংবাদপত্রের অংশ