প্রতিনিধি ২৩ এপ্রিল ২০২৪ , ১০:০২:০০
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু ছিল না। এর কারণ, মারাত্মক অনিয়মে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনগুলোতে ব্যাপকভাবে রিপোর্ট করা হয়েছে যে, সেগুলো অবাধ হয়নি অথবা নিয়ম লঙ্ঘন ছাড়া হয়নি। বাংলাদেশে ২০২৩ সালের মানবাধিকার ও অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশের স্থানীয় সময় রাত সাড়ে এগারটার দিকে প্রকাশ করা হয় ওই রিপোর্ট। বিশ্বের প্রায় সব দেশের ওপর প্রকাশ করা হয়েছে এই রিপোর্ট। এতে বাংলাদেশ অংশ তুলে ধরা হয়েছে ৭৯ পৃষ্ঠা। এতে বলা হয়, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে জেলখানা থেকে স্থানান্তর করে গৃহবন্দি অবস্থায় রাখা হয়েছে। অত্যাবশ্যকীয় হলেও তাকে চিকিৎসা নিতে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। এতে আরও বলা হয়েছে, ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চালানো হচ্ছে খেয়ালখুশিমতো আটক ও গ্রেপ্তার।
আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা জোরপূর্বক গুম, হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ২০২৩ সালে এর সংখ্যা কম ছিল। তুলে ধরা হয়েছে সংবাদ মাধ্যম ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতার বিষয়। এতে বলা হয়েছে, তাদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। তারা নিজেরা রিপোর্ট সেন্সর করতে বাধ্য হন। বিশেষ করে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে যে নির্বাচন হয়েছে তা অবাধ ও সুষ্ঠু ছিল না। তা বিঘ্নিত হয়েছে অনিয়মে। এর মধ্যে আছে ব্যালট বাক্স ভরাট করা, বিরোধীদলীয় এজেন্ট ও ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে ভীতি প্রদর্শন। নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রচারণাকালে, বিরোধীদলীয় প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে হয়রানি, ভীতি প্রদর্শন, খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তার ও সহিংসতার বিশ্বাসযোগ্য বহু রিপোর্ট আছে। বছর জুড়ে পার্লামেন্টের শূন্য আসনে উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলো চিহ্নিত হয়েছে ভীতি প্রদর্শন, অনিয়ম ও সহিংসতা দিয়ে। রিপোর্টে আরও বলা হয়, পার্লামেন্টের একটি উপনির্বাচনের প্রচারণাকালে ১৭ই জুলাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তারকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হিরো আলমের ওপর হামলা চালায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে তার মামলা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা। নির্বাচনের দিনে তার ওপর একটি ভোটকেন্দ্রে আবার হামলা হয়। সেখান থেকে তিনি সরে যাওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হন। কিন্তু পুলিশ তাকে শাসকদলের সমর্থকদের হামলা থেকে সুরক্ষা দেয়নি। এ ঘটনায় সন্দেহভাজন ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে কর্তৃপক্ষ।
যুক্তরাষ্ট্রের ওই রিপোর্টে বলা হয়, বিরোধীদলীয় নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে দেওয়ানি ও ফৌজদারি অভিযোগ আনতে আইনপ্রয়োগকারী রিসোর্সগুলোকে কাজে লাগিয়েছে। বছর জুড়ে রাজনৈতিক বিক্ষোভের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে বিএনপি’র হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। বিএনপি এবং অন্য দলগুলোর এমন দাবিকে সমর্থন করে সংবাদ মাধ্যম। বলা হয়, আটক করা হয়েছে অভিযুক্ত অনেককে। মানবাধিকার বিষয়ক পর্যবেক্ষকরা বলেন, এসব অভিযোগের বেশির ভাগই ভিত্তিহীন। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা ফৌজদারি অভিযোগের মুখোমুখি। বাংলাদেশে ইসলামপন্থি সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর নেতারা ও সদস্যরা বলছেন, সাংবিধানিকভাবে মত প্রকাশের যে স্বাধীনতা ও সমাবেশ করার অধিকার আছে, তারা তা চর্চা করতে পারছেন না আইনপ্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের হয়রানির কারণে। খুবই কম ক্ষেত্রে তাদেরকে র্যালি করার অনুমতি দিয়েছে পুলিশ। কিন্তু অন্য সবটাতে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
রিপোর্টে আরও বলা হয়, আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট দল, বিশেষত এর ছাত্র বিষয়ক সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ দেশ জুড়ে সহিংসতা ও ভীতি প্রদর্শন করেছে। নির্দলীয় কোনো ব্যক্তি, বিরোধী দলের কেউ অথবা অন্য কেউ- যদি তারা সরকারের সমালোচক বলে মনে হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে তারা এই সহিংসতা ও ভীতি প্রদর্শন করে। এক্ষেত্রে তারা দায়মুক্তি পায়। ১০ই এপ্রিল প্রথম আলো’র বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী নিন্দা প্রকাশের পর আওয়ামী লীগের যুব নেতাকর্মীরা বেরিয়ে আসেন এবং ওই পত্রিকাটির অফিসে ভাঙচুর করেন। সেখান থেকে তাদের এই অ্যাকশন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরাসরি সম্প্রচার করে।
জুলাইয়ে বিএনপি’র নেতাকর্মীরা যখন প্রধান প্রধান সড়ক ও ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে অবস্থান ধর্মঘটের চেষ্টা করেন, তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যে ধারাবাহিক সংঘর্ষ হয়। তাদেরকে এই কর্মসূচি থেকে সরিয়ে দেয় পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িতরা। সাধারণ একটি রীতি অনুযায়ী, বিএনপি’র প্রতিবাদের স্থান থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করে নেয়া হয় এবং তাদের ওপর হামলা চালাতে অনুমোদন দেয়া হয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। জুলাইয়ের সংঘর্ষে বেশ কিছু মানুষ আহত হয়েছেন। এর মধ্যে অনেক বিএনপি নেতা ছিলেন। পুলিশ এবং বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে অক্টোবরের শেষের দিকে রাজনৈতিক র্যালি সহিংসতায় পরিণত হয়। এর ফলে কমপক্ষে ১৩,৭০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। নভেম্বর পর্যন্ত কমপক্ষে ১৪ জন নিহত হয়েছেন।
জুনে মিডিয়ার রিপোর্টে বলা হয়, দেশ জুড়ে মুলতবি থাকা ক্রিমিনাল মামলাগুলোকে দ্রুতগতিতে শেষ করার জন্য ইউনিটগুলোকে নির্দেশ পাঠায় পুলিশ সদর দপ্তর। এর উদ্দেশ্য জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সম্ভাব্য প্রার্থীদের আইন দিয়ে আটকে দেয়া। বড় নেতাদের মুখোমুখি হতে হয় কয়েক ডজন অথবা শত শত মামলার। ৬ই জুলাই পুলিশ সদর দপ্তরের একটি মিটিংয়ের তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। তাতে সারা দেশের পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয় ২০১৩ সাল থেকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকদের বিরুদ্ধে যেসব ফৌজদারি মামলা রয়েছে সেগুলো সক্রিয় করতে। এতে বলা হয়, নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হবে বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের। বিএনপি’র সব নেতা ও জামায়াতের সব নেতা, যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আশা করেছিলেন, তারা কোনো না কোনো মামলায় অভিযুক্ত। এসব মামলা দ্রুতগতিতে শেষ করতে, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে বিচারবিভাগকে সহযোগিতার নির্দেশনা দেয়া হয় পুলিশকে।
আগস্টে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ রিপোর্ট করে যে, জুলাইয়ের শেষের দিকে বিএনপি’র একটি র্যালিকে সামনে রেখে বিরোধী দলের কমপক্ষে ১৫০০ জন নেতাকর্মী, ১৫ হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করে কর্তৃপক্ষ। অক্টোবরে নির্বাচনের ৯০ দিনেরও কম সময় আগে ঢাকায় বিএনপি’র বড় রকমের রাজনৈতিক র্যালির আগেই কর্তৃপক্ষ ১৫ মিনিটের মধ্যে ২০০ নেতাকর্মীকে আটক করে। বহু ঘটনায় বিরোধী দলের পাবলিক ফাংশন আয়োজনে হস্তক্ষেপ এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের ইভেন্ট সম্প্রচারে বাধা সৃষ্টি করেছে সরকার।
ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে স্বাধীন আন্দোলনে বাধা দেয়া হয়। আছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের সরকার পরিবর্তনে নাগরিকদের অক্ষমতা। রাজনৈতিক অংশগ্রহণে গুরুতর ও অযৌক্তিক বাধা। বাংলাদেশে সরকারে আছে মারাত্মক দুর্নীতি। দেশের ভেতরে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলোর ওপর আছে সরকারের কঠোর বিধিনিষেধ অথবা হয়রানি। সরকারের তরফ থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক গুম, নিষ্ঠুর নির্যাতন, অমানবিক ও অবমাননাকর আচরণ ও শাস্তি দেয়া হয়। আছে জীবনের প্রতি হুমকি। বিচারবিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে গুরুতর সমস্যা, রাজনৈতিক বন্দি ও আটক। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তায় হুমকি এমন অজুহাতে মিথ্যা অভিযোগসহ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র চেয়ারপারসনকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে বিদেশে যেতে দেয়া হয়নি। পক্ষান্তরে তাকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে বাংলাদেশের হাসপাতালে। এতে বলা হয়, ২০১৮ সালে ২০০৮ সালের দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের মামলায় তাকে ১০ বছরের জেল দেয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে তাকে জেলখানা থেকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ২০২০ সালে সেখান থেকে তাকে স্থানান্তর করে গৃহবন্দি করা হয়। রাজনৈতিক বন্দি ও আটক ব্যক্তিদের বিষয়ে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক ও দেশের ভেতরকার আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার তথ্যপ্রমাণে ঘাটতি আছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, তাকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য রাজনৈতিক ছক সাজানো হয়েছে। পক্ষান্তরে প্রসিকিউটররা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বেশ কিছু দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহার করেছেন। এই রিপোর্টে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার দিকেও দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সংবিধান সংবাদ মাধ্যম ও মিডিয়ার সদস্যসহ সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে। কিন্তু সরকার এই অধিকারে ঘন ঘন হস্তক্ষেপ করেছে। এক্ষেত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সীমাবদ্ধতা আছে। সরকারের হয়রানি অথবা প্রতিশোধ নেয়ার ভয়ে সরকারের সমালোচনার ক্ষেত্র মিডিয়ার সদস্যরা ও ব্লগাররা নিজেরাই সেন্সর করেছেন। এতে তুলে ধরা হয়েছে সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র, বিচারের ক্ষেত্রে হয়রানি, খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তারসহ নানা রকম নিষ্পেষণের কথা।