এক্সক্লুসিভ

বিএনপিকে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তাব করেছিল ভারত-যুক্তরাষ্ট্র!

  প্রতিনিধি ১ মে ২০২৪ , ১০:০৮:৫৭

শেয়ার করুন

বিএনপিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। দেশ দুটির পক্ষ থেকে বিএনপির উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করে এ পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল বলে দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে।

বিএনপির দায়িত্বশীল চারজন নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দলটির শীর্ষ পর্যায়ের তিনজন নেতার সঙ্গে দেশ দুটির ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিকরা পৃথক পৃথকভাবে এ বিষয়ে কথা বলেছেন। এর মধ্যে দুজন নেতার সঙ্গে আলোচনা হয় কারাগারে। গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় সহিংস ঘটনার পর ওই দুই নেতা কারাগারে ছিলেন। স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী ওই দুই নেতা কারাগারে বসেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে দুই শক্তিধর রাষ্ট্রের মনোভাবের কথা তাকে জানান। কিন্তু তারেক রহমান সাফ জানিয়ে দেন, বিদ্যমান (তখনকার) পরিস্থিতিতে নির্বাচনে যাওয়া সম্ভব নয়। তারেক রহমানের আরও যুক্তি ছিল, দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মী কারাগারে রয়েছেন।

তা ছাড়া নির্বাচনের ন্যূনতম প্রস্তুতিও বিএনপির ছিল না। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর তরফ থেকে সরকারের ওপর ওই সময় প্রচণ্ড চাপও ছিল বলে মনে করা হয়। পর্যবেক্ষকদের মতে, ওই চাপের পাশাপাশি সরকারবিরোধী আন্দোলন এবং বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান ওই সময় ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নের’ দিকে ছিল। ফলে দু-একজন নেতার আগ্রহ থাকলেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচন বর্জনের পথেই হেঁটেছে বিএনপি।

বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও সমমনা আরও বেশ কিছু দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে গত ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করে।

বিএনপি নেতাদের পাশাপাশি রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট আরও কিছু সূত্র থেকে জানা যায়, নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে ঢাকায় বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের দুজন নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকার প্রতিনিধিরা। তারা নির্বাচনে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে নির্বাচনের পরে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেবে। এক্ষেত্রে উদাহরণ ছিল কম্বোডিয়া এবং নিকারাগুয়ার ঘটনা।

২০২১ সালের নভেম্বরে নিকারাগুয়ায় কারচুপির নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র দেশটির একটি মন্ত্রণালয় ও ৯জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও তখন নিকারাগুয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। এরপর নিকারাগুয়ার প্রেসিডেন্ট ওরতেগা শপথ নিলে যুক্তরাষ্ট্র দেশটির ওপর আরেক দফা নিষেধাজ্ঞা দেয়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের জুলাই মাসে প্রধান বিরোধী দলবিহীন ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের কারণে কম্বোডিয়ার ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত থাকার অভিযোগে কিছু নাগরিকের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানালেও সেটি কার কার ওপর কার্যকর হয়েছে, তা জানা যায়নি। যাদের ভিসা বাতিল হয়েছে কিংবা ভিসা পাননি কেবলমাত্র সেই ব্যক্তিরাই ওই নিষেধাজ্ঞার কথা জানেন; যা নিয়ে জনমনে অস্পষ্টতা রয়েছে। নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার একাধিকবার বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আগে কখনই আলোচনা করে না।

অন্যদিকে, ভারতের পক্ষ থেকে মূলত আসন ভাগাভাগির নির্বাচনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য জানান, তার নিজের সঙ্গে ভারতের একাধিক কর্মকর্তার আলোচনা হয়েছে। তারা নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে বিএনপিকে অংশ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, সম্মানজনক এবং এক শ’র বেশি আসনে তাদের জয়লাভের বিষয়টি নিশ্চিত রয়েছে। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনে আসন-সমঝোতার ভিত্তিতে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়েও কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি বলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনা আছে। দলটির অনেক নেতা পরবর্তীকালে ওই অভিজ্ঞতার কথা বিভিন্ন মহলে বলেছেন ও আলোচনা করেছেন। তবে দলটির পর্যবেক্ষণ হলো; আন্তর্জাতিক মহলের আশ্বাসে ওই সময় বিএনপি অংশ নিলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসনের অতি উৎসাহ এবং আওয়ামী লীগের এমপি প্রার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণে শেষ পর্যন্ত তাদের ‘বেশি-সংখ্যক’ আসন দেওয়া যায়নি। ২৮৮ আসন পেয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও ক্ষমতাসীন দলের উচ্চ পর্যায়ের অনেকে ওই ফলাফলে খুশি হননি বলে পরবর্তী সময়ে জানা যায়। কারণ তারা মনে করেছেন যে, মাত্র ৭টি আসন দিয়ে বিএনপিকে ‘মার্জিনালাইজড’ বা প্রান্তিক পর্যায়ে ঠেলে দেওয়া হয়েছে; সেটি দেশের রাজনীতির জন্য ভালো হয়নি।

সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ওই ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি আর আলোচনা বা সমঝোতার পথে যায়নি। দলটি কারও আশ্বাসেও আর বিশ্বাস করেনি। দলটির নেতারা মনে করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের চাপে সরকার শেষ পর্যন্ত নমনীয় হবে। যদিও শেষ পর্যন্ত সরকার নমনীয় হয়নি। তবে প্রকাশ্য সংলাপ না হলেও বিএনপিকে নির্বাচনে নেওয়ার চেষ্টা যে ক্ষমতাসীন মহলের ছিল, সেটি নির্বাচনের আগে তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে। গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর এক টিভি সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে এক রাতে সব নেতাকে মুক্তি দেওয়ার কথা বলা হলেও দলটি রাজি হয়নি। তিনি বলেন, বার বার নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে, বিএনপি এলে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হবে। শুধু পিছিয়ে দেওয়া নয়, বলা হয়েছে সবাইকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত বিএনপিকে নির্বাচনে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল কি না জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, ‘এ বিষয়টি বিএনপির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটি বলতে পারবে। তবে এটা জানা না জানার বিষয়টি অর্থবহ নয়।’

যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ড. খান বলেন, ‘এ প্রসঙ্গে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির বাস্তবতা বিএনপি নির্বাচনে যাবে না কেন? জন্মের পর থেকে বিএনপি তো বারবার নির্বাচন করেই জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সরকার পরিচালনার দায়িত্বে এসেছে। কাজেই এ ক্ষেত্রে বিএনপির সামনে মূল নৈতিক প্রশ্নটি ছিল তারা কি একটি আপস ফর্মুলায় আসন ভাগাভাগি করে ক্ষমতার অংশ ভোগের উদ্দেশ্যে আওয়ামী সরকার অথবা বিদেশিদের প্রস্তাব মেনে নিয়ে হালুয়া রুটির ভাগ নিতে ৭ জানুয়ারির সাজানো নাটকে অংশগ্রহণ করবে অথবা বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনের মৌলিক আদর্শ যে গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার, তা পুনরুদ্ধার করে জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেবে।’

‘জনগণের দল হিসেবে এই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখেও কিন্তু বিএনপি দ্বিতীয় পথটাই সঠিকভাবে বেছে নিয়েছে। স্বভাবতই এই প্রহসনের নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার ক্ষেত্রে কোন পরাশক্তি কী পরামর্শ দিয়েছিল, সে প্রশ্নটি সম্পূর্ণ অবান্তর। বিএনপির চলমান আন্দোলনের অভীষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা’ যোগ করেন ড. মঈন খান।তিনি বলেন সে সময় ভাগাভাগি নির্বাচনে গেলে জনগণের সাথে বেইমানি করা হতো।

বিএনপির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির সদস্য স্থায়ী কমিটির আরেক নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু জানান, তিনি বিদেশে রয়েছেন, তাই বিষয়টি তার জানা নেই।


শেয়ার করুন