প্রতিনিধি ২০ জুন ২০২৪ , ১২:২০:০৮
পিতা মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর ইয়াজিদ খিলাফতে অধিষ্ঠিত হয়ে প্রথমেই মদীনায় যারা আনুগত্য প্রদর্শনে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিলেন তাদের কাছে আনুগত্য দাবী করে চিঠি পাঠান। অনেকেই এমনকি হযরত উমরের পুত্র আব্দুল্লাহও এতে রাজি হলেও ইমাম হুসাইন এবং জুবায়ের পুত্র আব্দুল্লাহ সময় চেয়ে মক্কায় চলে গেলেন। জুবায়েরের পুত্র আব্দুল্লাহ খেলাফতের আকাঙ্ক্ষী হলেও ইমাম হুসেইনের জন্য নিজের ইচ্ছাকে গোপন রেখেছিলেন। কুফাতে হযরত আলীর সমর্থকদের সংখ্যাও কম ছিল না। সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা ইমাম হুসাইনকে কুফায় আসতে আমন্ত্রণ জানান। ইমাম হোসেনের নিকট জনেরা অস্থিরমতি কুফাবাসীদের উপর নির্ভর করতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু অবশেষে আব্দুল্লাহর অনুরোধে ইমাম হুসাইন আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। ইমাম হুসাইন তার চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকীলকে আগেই কুফাতে পাঠান। মুসলিম ইমাম হুসাইনের পত্র নিয়ে কুফায় আসেন । কুফাবাসী মুসলিম ইবনে আকীলকে পেয়ে আনন্দিত হল। তাকে মুখতার ইবনে আবী ওবায়দা সাকাফীর বাড়িতে থাকতে দেওয়া হয়। অনুসারীরা দলে দলে মুসলিম ইবনে আকিলের সাথে সাক্ষাত করতে আসেন। প্রত্যেক দল আসার সাথে সাথে মুসলিম ইমাম হুসাইনের পত্র পড়ে শুনাতে থাকেন। তার মুসলিম ইবনে আকীলের হাতে বাইআত গ্রহণ করছিল । দেখতে দেখতে আঠারশো লোক তার হাতে বাইআত গ্রহণ করে। আব্দুল্লাহ ইবনে মুসলিম বাহেলী, এমারা ইবনে ওয়ালীদ এবং ওমর ইবনে সাআদ ইয়াজিদের কাছে এক পত্র পাঠিয়ে মুসলিম ইবনে আকীলের আগমন সম্পর্কে তাকে অবহিত করেন। ইয়াজিদ এই সংবাদ পেয়ে কুফার দায়িত্বভার গ্রহণ করার জন্য বসরা থেকে উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে সেখানে প্রেরণ করেন এবং কুফার গভর্নর পদ থেকে নোমান ইবনে বশিরকে সরিয়ে ইবনে জিয়াদকে নতুন গভর্নর নিয়োগ করে। জিয়াদের আসার খবর পেয়ে মুসলিম ইবনে আকীল মুখতারের ঘর থেকে এসে হানি ইবনে উরওয়ার ঘরে আশ্রয় নেন। মুসলিম ইবনে আকীলকে আশ্রয় দেয়ার অপরাধে উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ হানি ইবনে উরওয়কে নির্মমভাবে হত্যা করে।
হানির নিহত হওয়ার সংবাদ মুসলিম ইবনে আকিলের কাছে পৌছালে যত লোক তার হাতে বাইআত করেছিল তাদের সহ তিনি ইবনে জিয়াদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য বের হন । ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ এ সময় দারুল ইমারায় আশ্রয় নেয় এবং প্রাসাদের ভেতরে ঢোকার সবগুলো দরজা বন্ধ করে দেয়। তার দলীয় লোকেরা মুসলিমের সঙ্গী সাথীদের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হয় । আর যারা জিয়াদের সাথে দারুল ইমারার (প্রাসাদ) ভেতরে ছিল তারা মুসলিমের বাহিনীকে সিরিয়া থেকে সৈন্য বাহিনী আসার হুমকি দিচ্ছিল। ঐ দিন এভাবেই কেটে গেল এবং রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে এল । কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের মিথ্যা প্রলোভনে প্রতারিত হয়ে বেশির ভাগ মানুষই ইমাম হুসাইনের প্রতিনিধিকে (মুসলিমকে) ত্যাগ করেন। মুসলিমের সঙ্গী সাথীরা ধীরে ধীরে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তারা পরস্পর বলাবলি করতে লাগল আমরা কেন গোলযোগ আর বিশৃংখলার আগুন জ্বালাচ্ছি । আমাদের তো উচিৎ ঘরে বসে থাকা আর মুসলিম ও ইবনে জিয়াদের ব্যাপারে নিজেকে না জড়ানো। একপর্যায়ে তিনি দেখলেন কেউই তার সাথে নেই। মাগরিবের নামাজ আদায় করে অলিগলির পথ চলতে চলতে তিনি ‘তাওয়া’ নামের এক মহিলার ঘরে এসে পানি চাইলেন। মহিলা পানি দিলে তা তিনি পান করলেন এবং ঐ নারী মুসলিমকে আশ্রয় দিলেন । কিন্তু তার ছেলে গিয়ে ইবনে জিয়াদকে মুসলিমের অবস্থানের খবর জানিয়ে দিল । ইবনে যিয়াদ মুহাম্মদ ইবনে আশআসকে একদল লোক সহ মুসলিমকে গ্রেফতারের জন্য পাঠাল । মুসলিম তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলেন এবং তাদের সাথে একাই যুদ্ধে লিপ্ত হলেন ও তাদের বেশ কিছু লোককে হত্যা করলেন। একপর্যায়ে তাকে পেছন থেকে তীরের আঘাতে আহত করে বন্দী করে জিয়াদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। জিয়াদ হামারানকে দারুল ইমারার ছাদে নিয়ে মুসলিমকে হত্যার নির্দেশ দেয় ও কিছুক্ষণ পর তার শিরোচ্ছেদ করা হয়।
এদিকে হিজরী ৬০ সালে ইমাম হুসাইন বন্ধুদের বাঁধাকে অগ্রাহ্য করে পরিবারবর্গ ও কিছু সংখ্যক অনুসারীকে সাথে নিয়ে মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কুফার পথে মরুভূমি অতিক্রম করেই তিনি মুসলিম হত্যার সংবাদ পান। তখনই তিনি দ্বিধাগ্রস্ত হন কুফায় যাবেন কিনা। তখনও তার ফিরে আসার পথ ছিল। কিন্তু মুসলিমের আত্মীয় স্বজন মুসলিম হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলো। ইমাম হুসাইনও ভেবেছিলেন যারা তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তারা তাকে সাদরে গ্রহন করবেন। কিন্তু কুফা নগরের অভ্যন্তরে ইমাম হুসাইনের যে সমর্থকরা ছিলেন তারা ইয়াজিদের বাহিনীর ভয়ে বাইরে আসতে পারেনি। ইমাম হুসাইনের সাথে যে বেদুইনরা ছিল তারাও পরিস্থিতি খারাপ দেখে দলত্যাগ করে চলে যায়। এরপর ইমাম হুসাইনের সঙ্গে ৪০টি ঘোড়া ও শ দুয়েক মানুষ থেকে যায়। ইমাম হুসেইনের প্রধান সঙ্গী তাকে আজা ও সেলমা পাহাড়ে আশ্রয় নিতে পরামর্শ দেন। কিন্তু ইমাম হুসেইন স্ত্রী পরিজন নিয়ে মরুভূমি পাড়ি দিতে রাজি না হয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিছুদুর সামনে যেতেই আরবের তামিম গোত্রের আল-হুর নামের এক সেনাপতির নেতৃত্বে কুফার এক বিরাট অশ্বারোহী বাহিনী তাদের বাঁধা প্রদান করেন। ইমাম হুসাইনকে মক্কার দিক ব্যতিরেকে ওয়ালীর দিকে অথবা ডান বা বাম দিকে যাওয়ার জন্য বলা হয়। ইমাম হুসাইন কুফাকে ডান দিকে রেখে দুই দিন মরুভূমির পাশ দিয়ে ফোরাত নদীর দিকে অগ্রসর হন। আল-হুর এই সংবাদ রাজদরবারে প্রেরণ করেন।
(নিচের ছবিতে কারবালা যেখানে শায়িত আছেন হযরত আলী ও মা ফাতিমার সন্তান ইমাম হুসাইন।)