প্রতিনিধি ২৯ জুন ২০২৪ , ১১:০৫:৫৪
দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে রাজধানীতে সমাবেশ করেছে বিএনপি। সমাবেশ থেকে সরকার পতনের একদফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনরত রাজনৈতিক দল এবং জোটগুলোকে খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন, সংগ্রাম এবং লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন আরও তীব্র করারও ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আজকে বেগম খালেদা জিয়া ছাড়া গণতন্ত্র চিন্তা করতে পারি না। মিথ্যা মামলায় ৬ বছর কারাগারে আটক আছেন তিনি। আমরা খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই, বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করুন। অন্যথায় আপনাদেরকে যেকোনো পরিণতির জন্য তৈরি থাকতে হবে।
গতকাল রাজধানীর নয়াপল্টন দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপি’র উদ্যোগে ‘দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে’ সমাবেশে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেন। বিকাল পৌনে ৩টায় পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মধ্যদিয়ে সমাবেশ শুরু হয়। শেষ হয় সোয়া ৬টার দিকে। এই সমাবেশের জন্য দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হয়।
খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আজকে আমি সকলের তরফ থেকে এবং দলের তরফ থেকে আহ্বান জানাতে চাই, বেগম খালেদা জিয়া আমাদের গণতন্ত্রের প্রতীক।
আমাদের আন্দোলনের প্রতীক। বেগম খালেদা জিয়াকে বাঁচাতে হলে তাকে রক্ষা করতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে এবং আমাদের অধিকারকে ফিরে আনতে হলে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। একই সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আমি আহ্বান জানাতে চাই, আসুন, আজকে আমরা যেমন গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য যুগপৎ আন্দোলন, সংগ্রাম ও লড়াই করছি। দেশনেত্রীর মুক্তির আন্দোলনকে একইভাবে একত্রীভূত করে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সোচ্চার আওয়াজ তুলি।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে তারা চুক্তি করেছে। এই চুক্তিকে শুধু আমরা না, দেশের যারা আইন বিশেষজ্ঞ আছেন- তারা সবাই বলছেন, এটা বাংলাদেশ বিরোধী এবং স্বার্থ বিরোধী। আমরা পানি চাই, আমরা অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানি চাই, আমরা সীমান্ত হত্যা বন্ধ চাই, যেসমস্ত সমস্যা আছে সেই সমস্যার সমাধান আমরা চাই। তা না করে এই সরকার সবকিছুই বিলিয়ে দিয়ে এসেছে।
বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা এবং আন্দোলনে মৃত নেতাকর্মীদের প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা সমস্ত নেতাকর্মীদের মামলাগুলো প্রত্যাহার চাই। আমরা আমাদের সমস্ত নেতাকর্মী, যারা মারা গেছেন- তাদের জন্য ক্ষতিপূরর্ণ চাই। পাশাপাশি আমি তরুণদের বলতে চাই, তরুণদের হাতেই এদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করেছে। বারবার সময় ও সুযোগ আসে না। আজকে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে এই ভয়াবহ দানব, যে আমাদের দেশ ও গণতন্ত্রকে ধ্বংস করছে- তাদেরকে আমাদের নিচিহ্ন করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আজকে খেটে খাওয়া শ্রমিকরা চাল-ডাল, তেল কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। কেউ চিকিৎসা পায় না। লুট করে বিদেশে টাকা পাচার করেছেন। সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান, তিনি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। আমরা চিন্তা করতে পারি না। তিনি দেশের গণতন্ত্র ধ্বংসের সঙ্গে জড়িত। অবিশ্ববালাগে যখন দেখি, পুলিশের সাবেক প্রধান হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। এনবিআর’র একজন কর্মকর্তা কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক। কিন্তু রাঘববোয়ালদের এখন পর্যন্ত ধরা হচ্ছে না। আজকে এই দেশ এই লুটেরাদের হাতে নিরাপদ না। আজকে এই সরকার দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে ফখরুল বলেন, এই আন্দোলন এখনো চলছে। এই আন্দোলনের জন্য আপনারা অনেকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আমাদের ৬০ লক্ষ মানুষের বিরুদ্ধে। মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে। আমাদের ৭০০-র বেশি মানুষকে গুম করে ফেলা হয়েছে। আজকে আমাদের প্রায় ৪ হাজার নেতাকর্মীকে মিথ্যা মামলায় সাজা দেয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই, এদেশের গণতন্ত্রকে চিরদিনের জন্য নির্বাসিত করা।
মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপি’র নেতাকর্মীদের ত্যাগ এদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কিন্তু এটাই এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত নয়। আমাদেরকে রাজপথে আরও তীব্র, তীব্র এবং তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এই পরিবর্তন যে নিয়ে আসে, এই পরিবর্তন কিন্তু আমাদের মতো শুধুমাত্র বয়সী লোকদের দিয়ে আসে না। পরিবর্তন আসে তরুণ-যুবকদের মাধ্যমে।
বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, ৯ বছর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এই রাজপথে সংগ্রাম করেছিলেন খালেদা জিয়া। তিনি নিজে পায়ে হেঁটে হেঁটে মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বারবার তাকে নির্যাতিত করা হয়েছে। কিন্তু তিনি কখনোই রাজপথ ছাড়েননি। সংগ্রাম করেই সেই স্বৈরাচারকে পরাজিত করে এদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুতরাং এই বাংলাদেশে বেগম খালেদা জিয়া এবং গণতন্ত্র, এই দু’টাকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। এখন বাংলাদেশে গণতন্ত্র মানেই বেগম খালেদা জিয়া।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমাদের লক্ষ্য একটা, সেটা হচ্ছে- বেগম খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি চাই। কারণ তিনি এদেশের মানুষের পাশে থেকে সারাটা জীবন সংগ্রাম করেছেন। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানের সেনানিবাসের কারাগারে বন্দি করেছিল। স্বাধীনতার পরেই তাকে মুক্ত করা হয়েছিল। সেজন্য আমি সবসময় বলি, বেগম খালেদা জিয়া হচ্ছেন এদেশের প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা।
সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, একটা ব্যানারে দেখলাম, খালেদা জিয়া সুস্থ হলে দেশ সুস্থ থাকবে। কথাটা ঠিক। বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ, আজকে পুরো জাতি অসুস্থ হয়ে গেছে। চোর-ডাকাত-বাটপার-বদমাইস সবাই মুক্তি পেয়ে যায়, আর বেগম খালেদা জিয়াকে আপনি (প্রধানমন্ত্রী) মুক্তি দিতে চান না। আমরা পরিষ্কার বলতে চাই, দেশনেত্রীকে যেকোনো মূল্যে মুক্তি দিতে হবে। তার মুক্তির স্বার্থে কোনো আপস কারও সঙ্গে হবে না, তার মুক্তি ইনশাআল্লাহ্ আমরা করে ছাড়বো। দেশনেত্রীর মুক্তির লক্ষ্যে কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। এরপর আরও কর্মসূচি আসবে। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমরা বহুদিন পরে প্রথম বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে মুখ খুলেছি, এই মুক্তির আন্দোলন থামবে না, কোথায় গিয়ে থামবে সেটা আল্লাহ্ই বলতে পারেন।
স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, দেশনেত্রী আমাদের মাঝে মুক্ত নন, এখনো তিনি কারাগারে, আবার তিনি চিকিৎসা পান না যেটা মানুষের মৌলিক অধিকার, তিনি জামিন পান না, খুনের আসামি জামিন পায়, মৃত্যুদণ্ডের আসামি জামিন পায়। সকাল বেলা ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে আজকে এ রকম আবহাওয়ার মধ্যেও সবাই এসেছেন আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ। তাই বলবো, আমরা যখন নামছি একবার চেষ্টা করি। আমরা প্রতিদিন বক্তৃতা দেই না, আবার বক্তৃতা না দিতে পারলে মনটা খারাপ লাগে। আর আমার নেত্রী ৭ বছর ধরে মঞ্চে আসেন না, ৭টি বছর ধরে তার কণ্ঠ জনগণ শুনতে পায় না। তাই আসেন বক্তৃতা থামান, বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে ঘরে ফেরেন। তাহলেই দেশ মুক্ত, গণতন্ত্র মুক্ত, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব মুক্ত।
দলের আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমরা দেখেছি, বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু তাকে পাঁচ বছরের সাজা দেয়া হলো! আসল অভিযোগ হলো, বেগম খালেদা জিয়া জনপ্রিয় নেত্রী এবং তাকে মানুষ ভালোবাসে। তাকে বাইরে রেখে অন্যায় করা যাবে না। সেজন্য ২০১৮ সালে তাকে সাজা দেয়া হয়।
স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে আজকে আইনের শাসন বলে কিছু নাই। যেখানে আইনের শাসন নাই, যেখানে অন্যায় আইন হয়ে যায়, যেখানে মানবাধিকার নাই, যেখানে বিরোধী দলসহ ভিন্নমতকে রুদ্ধ করে রাখে, যেখানে জীবনের নিরাপত্তা নেই, যেখানে জেলখানায় মানুষের মৃত্যু হয়, সেই দেশে শুধু মাত্র প্রতিবাদ করে, এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো যাবে না। যেখানে অন্যায় আইনে পরিণত হয়ে যায় সেখানে প্রতিরোধ কর্তব্য হয়ে পড়ে। আজকে প্রতিরোধ অনিবার্য। দেশনেত্রীকে মুক্ত করতে হলে প্রতিরোধে নামতে হবে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, বেগম খালেদা জিয়াকে আর কারাগারে আটক করে রাখা যাবে না। নতুন উদ্যমে এব নতুন করে আন্দোলন শুরু হয়েছে। বেগম জিয়াকে মুক্ত করতে হলে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সেই লড়াই করতে হবে।
বেলা ১২টার পর থেকেই সমাবেশস্থলে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে জড়ো হতে শুরু করেন বিএনপি এবং দলটির অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নেতাকর্মীদের পদচারণায় নয়াপল্টন সরগরম হয়ে ওঠে। নামে নেতাকর্মীদের ঢল। ঢাকা মহানগর উত্তর, দক্ষিণ ঢাকা জেলা ছাড়াও এই সমাবেশে বৃষ্টি উপেক্ষা করে গাজীপুর জেলা ও মহানগর, নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ থেকে মিছিলসহকারে সমাবেশে যোগ দেন। তবে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি এবং কেন্দ্রীয় যুবদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী নেতারা বিশাল শোডাউন করে এই সমাবেশে যোগ দেন।
সরজমিন দেখা গেছে, নয়াপল্টনের আশপাশে এলাকা থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল সমাবেশস্থলে আসেন নেতাকর্মীরা। ঢাকার বিভিন্ন ইউনিট থেকে জাতীয় ও দলীয় পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে স্লোগান দেন নেতাকর্মীরা। ঢাকা আশপাশের জেলা থেকেও নেতাকর্মীরা আসেন। তারা বিভিন্ন রঙের ক্যাপ পরে সমাবেশে অংশ নেন। এ সময় নেতাকর্মীদের মিছিল ও স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা নয়াপল্টন এলাকা। তারা বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দেন।
এদিকে সমাবেশকে ঘিরে নয়াপল্টন এলাকায় পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সতর্ক অবস্থানে ছিলেন তারা। মোতায়েন করা হয় এপিসি (সাঁজোয়া যান), প্রিজনভ্যান ও জলকামান।
বিএনপি’র প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর পরিচালনায় সমাবেশে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, মোহাম্মদ শাহজাহান, এজেডএম জাহিদ হোসেন, শামসুজ্জামান দুদু, নিতাই রায় চৌধুরী, আহমেদ আযম খান, আসাদুজ্জামান রিপন, কেন্দ্রীয় নেতা জয়নুল আবদিন ফারুক, ফরহাদ হালিম ডোনার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, রুহুল কবির রিজভী, খায়রুল কবির খোকন, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, আবদুস সালাম আজাদ, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, সাইয়েদুল আলম বাবলু, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, শিরিন সুলতানা, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের রফিকুল আলম মজনু, উত্তরের আমিনুল হক, মহিলা দলের আফরোজা আব্বাস, স্বেচ্ছাসেবকদলের এসএম জিলানি, কৃষক দলের শহিদুল ইসলাম বাবুল, শ্রমিক দলের আনোয়ার হোসাইন, মুক্তিযোদ্ধা দলের সাদেক আহমেদ খান, তাঁতী দলের আবুল কালাম আজাদ, মৎস্যজীবী দলের আবদুর রহিম, ছাত্রদলের রাকিবুল ইসলাম রাকিব প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।