স্বাস্থ্য

সাড়ে ৪ কোটি মানুষ ফ্যাটি লিভার রোগে আক্রান্ত

  প্রতিনিধি ১৩ জুন ২০২৪ , ১২:০৪:৪২

0Shares

শেয়ার করুন

বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষ নন-অ্যালকোহলিক স্টিয়াটো হেপাটাইটিস (ন্যাশ) বা ফ্যাটি লিভার রোগে আক্রান্ত।তন্মধ্যে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত ১৮ লাখ মানুষ। সচেতনতা না বাড়ালে অদূর ভবিষ্যতে দেশের মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে।

দিনে দিনে এই সংখ্যা বাড়ছে। প্রতি তিনজনে একজনের ফ্যাটি লিভার রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত সাড়ে চার কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় এক কোটি মানুষ সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি আছে। জীবনযাত্রার ধরন পরিবর্তনের পাশাপাশি খাদ্যাভাস, হাঁটার অভ্যাস, ওজন কমানোর মাধ্যমে ফ্যাটি লিভার ও ন্যাশ প্রতিরোধ করা যায়। সপ্তম আন্তর্জাতিক ফ্যাটি লিভার বা ন্যাশ দিবস উপলক্ষে গতকাল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘হেপাটোলজি সোসাইটি’ আয়োজিত ‘কম খাই হাঁটি বেশি, ফ্যাটি লিভার দূরে রাখি’- বিষয়ক গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এই পরামর্শ দিয়েছেন।

 

ফ্যাটি লিভার এবং এর প্রতিরোধ ও প্রতিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে আজ বিশ্বব্যাপী সপ্তমবারের মতো পালন হতে যাচ্ছে Annual Global Fatty Liver Day (যা পূর্বে International NASH Day) হিসেবে পরিচিত। এই বছরের প্রতিপাদ্য ‘ACT NOW SCREEN TODAY’। আলোচনা অনুষ্ঠানে জানানো হয়, লিভার রোগজনিত মৃত্যু বিশ্বব্যাপী মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে পরিগণিত। লিভার সিরোসিস ও ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে লিভারে চর্বিজমাজনিত প্রদাহ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে স্টিয়াটো-হেপাটাইসিস।

 

অতিরিক্ত চর্বি জমা হওয়ার কারণে যকৃতে যে প্রদাহ সৃষ্টি হয় তাকেই স্টিয়াটো-হেপাটাইটিস বলা হয়। ফ্যাটি লিভারের বিপদজনক পরিণতি হচ্ছে ন্যাশ। নির্ণয়হীন ও নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় ফ্যাটি লিভার বিপদজনকভাবে এর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি করা ছাড়াও যকৃতে চর্বি জমার আরও বেশকিছু খারাপ দিক রয়েছে। এই রোগটি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং শরীরে ইনসুলিন হরমোনের কার্যকারিতা কমে যাওয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। সারা বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশও এ রোগের প্রাদুর্ভাব আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ডা. মো. গোলাম মোস্তফার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন- সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল অধ্যাপক ডা. এএসএম মতিউর রহমান (অব.) এবং প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন- পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. রুহুল আমিন, ন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আলী, সাংবাদিক মো. মুসা মিয়াসহ বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদরা।

বক্তারা জানান, ফ্যাটি লিভার বিশ্বব্যাপী একটি উদ্বেগজনক জনস্বাস্থ্য সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এমনকি দীর্ঘমেয়াদি লিভার প্রদাহের কারণ হিসেবে ভাইরাসকে অতিক্রম করে ফ্যাটি লিভার প্রধান্য বিস্তার করছে। বাংলাদেশে প্রতি তিনজনে একজনের ফ্যাটি লিভার আছে। প্রায় চার কোটি পঞ্চাশ লাখ মানুষ ফ্যাটি লিভারে ভুগছে এবং এরমধ্যে প্রায় এক কোটি মানুষ সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকিতে আছে, অথচ প্রায় ক্ষেত্রে শুধুমাত্র খাদ্যাভ্যাস, হাঁটার অভ্যাস ও জীবনযাত্রার ধরন পরিবর্তন এবং ওজন কমানোর মাধ্যমে ফ্যাটি লিভার ও ন্যাশ প্রতিরোধ করা যায়।

সাম্প্রতিককালে এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা কার্বো-হাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার বিশেষত ভাত বেশি গ্রহণ করছেন এবং সেই তুলনায় শারীরিক পরিশ্রম বা হাঁটা চলাফেরা কম করছেন তাদের ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচাইতে বেশি। বাহিরের খাবার গ্রহণ, দিনে পাঁচ ঘণ্টার উপরে যাদের বসে থাকতে হয় এবং একই সঙ্গে কায়িক পরিশ্রম কম তাদের ঝুঁকিও সবচাইতে বেশি।

ফ্যাটি লিভার রোগ-প্রতিরোধে কর্মপন্থা নির্ধারণে হেপাটোলজি সোসাইটি ১১টি সুপারিশ তুলে ধরে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রত্যেক ব্যক্তির সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন এবং প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট করে হাঁটতে হবে; দড়ি লাফ এবং সাইকেল চালানো শরীর চর্চার জন্য ভালো; দুধ, ফল, শাক-সবজি খাওয়া বাড়ানো এবং চিনিযুক্ত খাবার, পানীয়, চকলেট, আইসক্রিম, ফাস্ট ফুড এবং ট্রান্স-ফ্যাটের পরিমাণ কমানোর মাধ্যমে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে ক্যালরি গ্রহণ কমাতে হবে; শরীরচর্চা বাড়ানো যায় এ রকম পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। দেশের প্রতিটি স্কুল এবং প্রশাসনিক ওয়ার্ডে খেলার মাঠ রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং প্রতিটি শিশুকে খেলতে এবং অন্যান্য শারীরিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে; মেইন রোডের পাশে বাইসাইকেল চালানো এবং হাঁটার জন্য আলাদা লেন তৈরি করা, যা স্বাস্থ্য এবং অর্থনীতি উভয়ের জন্য উপকারী হবে; গণসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অধিক স্যাচুরেটেড ফ্যাট, চিনি এবং লবণযুক্ত জাঙ্কফুড এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিহার করতে উৎসাহিত করতে হবে; প্রক্রিয়াজাত খাবারের পুষ্টিমান সঠিক রাখার জন্য (ট্রান্স ফ্যাট, স্যাচুরেটেড ফ্যাট, চিনি এবং লবণ পরিহার) খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় আনতে হবে; সফ্ট ড্রিংক্সের পরিবর্তে ফ্রেস ফলের জুস এবং পানি পানকে উৎসাহিত করতে হবে।

ছোট-বড় সবার জন্য পার্ক, খেলার মাঠ, স্কুল এবং কর্মস্থলে পরিষ্কার পানির ব্যবস্থা করতে হবে; প্রক্রিয়াজাত খাবারের ক্ষেত্রে প্যাকেটের গায়ে পুষ্টিমান এবং শক্তিমান (ক্যালরি) উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক করতে হবে; সব চিকিৎসককে ফ্যাটি লিভার সংক্রান্ত পর্যাপ্ত জ্ঞান দিতে হবে, এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর দিকে খেয়াল রাখতে হবে যাতে তারা ন্যাশের ঝুঁকিতে না পড়ে; ব্যবহার ও প্রয়োগ কমানোর জন্য চর্বি বা চিনি কর ধার্য করার চিন্তা করা যেতে পারে।


শেয়ার করুন

0Shares

আরও খবর

Sponsered content