প্রতিনিধি ২২ আগস্ট ২০২৪ , ৩:১৩:২২
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে দেশের ৮ জেলা। বিশেষ করে ফেনীতে বন্যায় নেমে এসেছে মানবিক বিপর্যয়। পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ। তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও অভ্যন্তরীণ সব সড়ক। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তিন উপজেলার বাসিন্দারা। বিশাল জলরাশিতে শেষ হয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্ন। নষ্ট হয়েছে ফসলি ভূমি, মাছের ঘের, পোল্ট্রি খামার। নিহত অন্তত দুই। প্রাণে বাঁচাতে হাজার হাজার মানুষের আকুতি। এমন পরিস্থিতিতে উদ্ধার অভিযানে নেমেছে সেনাবাহিনী, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।এছাড়াও জিয়া সাইবার ফোর্স ফেনী জেলার নেতা-কর্মীদেরও দেখা যায়।
ব্যক্তি উদ্যোগেও অনেকে নৌকা ও শুকনো খাবার নিয়ে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন। পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলায় বন্যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এসব উপজেলার অধিকাংশ ঘরবাড়ি পানির নিচে। এ ছাড়াও ফেনী সদর, দাগনভূঞা ও সোনাগাজীতেও অসংখ্য মানুষ পানিবন্দি। জেলা শহরের মূল সড়কে কোমরপানি উঠে গেছে বিকালেই। অন্য উপজেলাগুলোতেও লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি। জেলা প্রশাসন দুর্গতদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা ও শুকনো খাবার পৌঁছে দিতে কাজ করছে। ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ভয়াবহ এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাতে ভারতের ত্রিপুরার ডিম্বুর হাইড্রোইলেক্ট্রিক বাঁধ খুলে দেয়ায় হঠাৎ মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে কখনো বড় ধরনের বন্যার মুখোমুখি না হওয়া এসব মানুষ। বুধবার ভোর থেকেই পানি বাড়তে থাকে। বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ফেনীর মুহুরী নদীর পানি। মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে এ নিয়ে তৃতীয়বার বন্যার কবলে পড়েছে জেলার তিন উপজেলার দুই শতাধিক গ্রাম। উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, পরশুরামে স্বেচ্ছাসেবক ছাত্রদের সহায়তায় দিবাগত রাত ১২টা থেকে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা লোকজনকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম জানান, টানা বর্ষণ আর ভারতীয় পাহাড়ি ঢলে মুহুরী-কহুয়া-সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২৭টি ভাঙা অংশ দিয়ে হু হু করে পানি ঢুকছে লোকালয়ে। গত বন্যায় ভেঙে যাওয়া ২৬টিসহ নতুন করে আরও একটি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পরশুরাম উপজেলা ইউএনও আফরোজা হাবিব জানিয়েছেন, প্রবল স্রোতে ভেসে যাওয়ায় একজন নিখোঁজ রয়েছেন। মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত প্রায় ১০০ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। ফুলগাজী ইউএনও তানিয়া ভূঁইয়া জানান, উপজেলায় স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায় ৬ ইউনিয়নের প্রায় অধিকাংশ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। মঙ্গলবার রাত ১০টা থেকে ফায়ার সার্ভিসের সদস্য এবং স্বেচ্ছাসেবক ছাত্রদের সহায়তায় ডিঙি নৌকা দিয়ে লোকজনকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০০ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। একজনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গিয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। ফুলগাজীর আনন্দপুর ইউনিয়নের বন্দুয়া গ্রামের শহিদুল্লাহ চৌধুরী কিসমত জানান, মঙ্গলবার বাড়ির উঠানে পানি থাকলেও বুধবার সকাল থেকে ঘরে পানি ঢুকে যায়। মাহবুবা তাবাচ্ছুম ইমা নামে এক স্বেচ্ছাসেবক জানান, গত দু’দিন ধরে শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছে। পানি বেশি থাকায় ডিঙ্গি নৌকায় উদ্ধার অভিযান চালানো যাচ্ছে না। স্পিডবোট ছাড়া ফুলগাজী-পরশুরামের দুর্গত এলাকাগুলোতে যাওয়া সম্ভব নয়। পরশুরামের শালধর গ্রামের আবু ইউসুফ বলেন, বেশির ভাগ এলাকার একচালা ও পাকাঘর ডুবে গেছে। কোথাও আশ্রয় নেয়ার মতো অবস্থান নেই। ফেনী আবহাওয়া অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যবেক্ষক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ৯৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ৪৮ ঘণ্টায় ২৮২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী কয়েকদিন জেলা জুড়ে বৃষ্টি অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
নোয়াখালীতে ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি: নোয়াখালীতে ফেনীর মুহুরী নদীর পানি ঢুকছে। এতে নোয়াখালীর ৯টি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। নতুন করে জেলার অনেক এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। এদিকে নোয়াখালীতে গত ২৪ ঘণ্টায় জেলা আবহাওয়া অফিস ৭১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। এরমধ্যে ৯টি উপজেলার ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। গ্রামীণ সব সড়ক, ফসলি মাঠ এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। ভেসে গেছে পুকুর ও খামারের মাছ। কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে তলিয়ে গেছে পুরো নোয়াখালী। ৯টি উপজেলার সবক’টিতেই বসতঘর, গ্রামীণ সড়ক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। এতে লোকজনের মধ্যে বন্যার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। খাল উদ্ধার ও পানি নিষ্কাশনে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চান স্থানীয়রা। জানা গেছে, টানা এক সপ্তাহের ভারী বর্ষণে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে পুরো নোয়াখালী জেলা জুড়ে। জেলার সদর, সেনবাগ, সোনাইমুড়ী, চাটখিল, বেগমগঞ্জ, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ, সুবর্ণচর উপজেলার বেশির ভাগ নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে সীমাহীন ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন এসব উপজেলার বাসিন্দারা।
জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, সকলের সহযোগিতায় বিভিন্ন অবৈধ বাঁধ কেটে পানি স্বাভাবিক করার কাজ শুরু হয়েছে। বৃষ্টিপাত কমে গেলে পানি কমে যাবে। এ ছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে আশ্রয় দেয়ার জন্য উপজেলা পর্যায়ের সকল মাধ্যমিক, প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিষ্ঠান প্রধানদের বলা হয়েছে। যেখানে যে সহযোগিতা প্রয়োজন আমরা তা করছি।
রামগতি-কমলনগরে তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি: গত ১০ দিনের টানা বৃষ্টি ও মেঘনা নদীর অস্বাভাবিক জোয়ারে লক্ষ্মীপুরের রামগতি-কমলনগর উপকূলের ৪০ গ্রাম ডুবে প্রায় ৩ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বাড়ির উঠান মাড়িয়ে বসতঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে উপকূলবাসীর দুঃখ-কষ্টের অন্ত নেই। এদিকে, চরাঞ্চলসহ সকল এলাকা প্লাবিত হয়েছে। নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৬ ফুটের বেশি পানি বেড়েছে। ফসলের মাঠ তলিয়ে যাওয়ায় ধানের চারা পচে নষ্ট হয়ে গেছে। আমন ধানের আবাদ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। রামগতি উপজেলা চর আলেকজান্ডার, চর গাজী, পোড়াগাছা, চর রমিজ, বড় খেরী, চর আবদুল্লাহ ও চর বাদাম ইউনিয়নসহ উপজেলার প্রায় সব গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে গেছে। কমলনগর উপজেলার চর ফলকন, চর জাঙ্গালিয়া, চর কালকিনি, চর মার্টিন, চর লরেন্স, সাহেবের হাট, তোরাবগঞ্জ, চর কাদিরা ও পাটারিরহাট ইউনিয়ন এখন পানির নিচে।
কুমিল্লায় ভারী বর্ষণে জলাবদ্ধতা, নিম্নাঞ্চল প্লাবিত: কুমিল্লার গোমতী নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। পানি বাড়ার ফলে জেলার আদর্শ সদর, বুড়িচং ও দেবিদ্বার এলাকার কিছু অঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। নদী তীরবর্তী এলাকায় ঘরবাড়িতে পানি উঠতে শুরু করেছে। ফলে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে কুমিল্লায়। আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, সাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ এবং সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর ফলে টানা বৃষ্টি হচ্ছে।
আখাউড়ায় তলিয়ে গেছে স্থলবন্দর-সেতু, নিহত ১: ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর। এতে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম এবং যাত্রী পারাপার বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ করা হয়েছে ইমিগ্রেশনের সাময়িক কার্যক্রম। তাছাড়া একটি বেইলি সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বন্ধ রয়েছে আখাউড়া-আগরতলা সড়কে যান চলাচলও। পানিতে ডুুবে মৃত্যু হয়েছে এক অন্তঃস্বত্ত্বা নারীর।
খাগড়াছড়িতেও পানিবন্দি হাজার হাজার মানুষ: পাঁচ দিনের টানা বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে বিপর্যস্ত খাগড়াছড়ির বিভিন্ন এলাকা। জেলা সদরের শব্দমিয়া পাড়া, মুসলিম পাড়া, শান্তিনগর, ফুট ভিল, মেহেদীবাগসহ নিচু এলাকার কয়েকশ’ ঘরবাড়ি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়াও জেলার দীঘিনালা উপজেলার কবাখালি, মেরুং ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার লোক।
কমলগঞ্জে ধলাই নদীর ভাঙনে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি: কমলগঞ্জে ধলাই নদীর পানি বেড়ে প্রতিরক্ষা বাঁধের ১৩ স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে পুরো উপজেলা জুড়েই বানের জলে থই থই করছে। পানিতে তলিয়ে গেছে অসংখ্য বসতঘর, গ্রামীণ সড়ক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে কমপক্ষে ১ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। গতকাল সকাল ৯টায় ধলাই নদীর পানি বিপদসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও দুপুরের পর থেকে নদীর পানি কমতে শুরু করেছে।
হবিগঞ্জের খোয়াই নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে ঘরবাড়ি: ভারী বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বেড়ে চলেছে হবিগঞ্জের খোয়াই নদীর পানি। নদীটির সবগুলো পয়েন্টেই বিপদসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়ে শহরতলীর জালালাবাদ এলাকার বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করছে। এতে করে রিচি ও লোকড়া ইউনিয়নের হাওরে রোপা আমন ও মৎস্য খামারিদের ক্ষতি হয়েছে। নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করেছে। বিভিন্ন বাঁধের দুর্বল স্থানে পানি প্রবেশ করে শহরে পানি ঢুকেছে। খোয়াই নদীর ভয়াল এ অবস্থার কারণে আতঙ্কে রয়েছেন শহরের বাসিন্দারা।
সাজেকে সড়ক ডুবে আটকা ২৫০ পর্যটক: রাঙ্গামাটিতে কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সাজেক-বাঘাইহাট সড়কের মাচালং ও বাঘাইহাট ডুবে গেছে। এতে করে সাজেকে ঘুরতে যাওয়া অন্তত ২৫০ পর্যটক আটকা পড়েছে।