প্রতিনিধি ১১ আগস্ট ২০২৪ , ১০:৪৮:০৪
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরপরই পরিবর্তনের হাওয়া বইছে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। একের পর এক বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতিবাজ ও দলীয় কোটায় নিয়োগ-প্রমোশনপ্রাপ্তদের পদত্যাগের দাবিতে শুরু হয় বিক্ষোভ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক খাতে আর্থিক দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও দখলদারদের বিতাড়িত করতে ও নিয়ন্ত্রণ নিতে বিক্ষোভ করছেন সংশ্লিষ্টরা কর্মকর্তারা। এতে ব্যাংক খাতে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছে। এদিকে বিভিন্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং পরিচালকরা পালিয়ে রয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠান এখন অভিভাবকশূন্য।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সরকার পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারও পদত্যাগ করেছেন। এর আগে চার ডেপুটি গভর্নর, উপদেষ্টা ও আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধানকে পদত্যাগে বাধ্য করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষুব্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এতে পুরো ব্যাংক খাত অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও। বিশেষ করে জোর করে মালিকানা পরিবর্তন করা ব্যাংকগুলোতে শুরু হয়েছে মালিকানা ফিরে পাওয়ার আন্দোলন।
অনেক দিন ধরেই ব্যাংকসহ দেশের আর্থিক খাত নাজুক পরিস্থিতি চলছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন অনিয়ম, দুর্নীতি, দখলদার আর ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে পুরো আর্থিক খাতে ভঙ্গুর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এসব অপকর্মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিতাড়িত করে, দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র মতে, ১৫ বছর আগে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সময় দেশে খেলাপি ঋণ ছিল প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। তবে পুনঃতফসিল করা ঋণ, আদালতের আদেশে স্থগিত করা ঋণ মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, গভর্নরের পদত্যাগের পর ব্যাংকের হাল ধরেন ডেপুটি গভর্নররা। তবে রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের চার ডেপুটি গভর্নরকে কাজে ফেরার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। নূরুন নাহারকে গভর্নরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক নয়, আর্থিক দুর্নীতি ও অর্থপাচার এবং দখলদারদের বিতাড়িত করতে বিক্ষোভ হচ্ছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে। ১৬ বছর ব্যাংক খাতে আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের মনোনীত ব্যক্তিদের নজিরবিহীন স্বেচ্ছাচারিতার লুটপাটের অবসান চাচ্ছে সবাই। নামে- বেনামে ঋণ দিয়ে তা পাচারে সহায়তাকারীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা, অবৈধ নিয়োগ বাতিল, জোর করে চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহালসহ বিভিন্ন দাবিতে কয়েকটি ব্যাংকের সামনে বিক্ষোভ হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের ব্যাংক খাতকে ঢেলে সাজাতে হবে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রশাসনিক কাঠামো দ্রুত পুনর্গঠন করতে হবে। কারণ, এখানে এখন কেউ নেই। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকানা নিয়ে অরাজকতা বন্ধ করতে হবে। তবে পুরো ব্যাংক খাত একসঙ্গে সংস্কার করতে সময় লাগবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বৃহস্পতিবার শপথ নেয়ার পর শনিবার সচিবালয়ে প্রথম অফিস করেন। তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আর্থিক খাতে যারা কেলেঙ্কারি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ছাত্র অভ্যুত্থানের পর গত মঙ্গলবার প্রথম কর্মদিবসেই ইসলামী ব্যাংকের এক্সিকিউটিভসহ (নির্বাহী কর্মকর্তারা) যারা অবৈধভাবে নিয়োগ পেয়েছেন তাদের নিয়োগ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে। ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক দখলের পর এসব নির্বাহী কর্মকর্তারা শেখ হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় এস আলম গ্রুপের নির্দেশে নিয়োগপ্রাপ্ত বলে দাবি কর্মকর্তাদের।
গত মঙ্গলবার থেকে এসব দাবি করে আসছেন ইসলামী ব্যাংকের সিবিএ নেতারা। পরে বুধবার এস আলমের আমলে পদোন্নতি পাওয়া অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) কায়সার আলী ব্যাংকে এলে তাকে জোর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। শুধু তাই নয়, বৃহস্পতিবার রাজধানীর দিলকুশায় ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে কয়েকজনকে মারধর করে বের করে দিতে দেখা গেছে। এর ধারাবাহিকতায় রোববারও এস আলমের পক্ষে যুবদল নেতা নয়ন একটা গ্রুপ নিয়ে ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গুলি চালায়। এতে ৬ জন আহত হয়।
এদিকে মালিকানা ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করছেন বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পারটেক্স গ্রুপের এম এ হাসেম পরিবার। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বুধবার কয়েকজন শেয়ারহোল্ডারের নামে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও বিএসইসি চেয়ারম্যানের বরাবর চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠিতে ব্যাংকের আর্থিক খারাপ অবস্থার চিত্র তুলে ধরে অবিলম্বে মালিকানা বদল চাওয়া হয়। এরপর গত ৮ই আগস্ট গুলশানে ইউসিবি’র প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন ব্যাংকের দেড় শতাধিক শেয়ারধারী। ওই সময় তারা বিভিন্ন ফেস্টুন প্রদর্শন করে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর ‘বিদেশে অর্থপাচার’ ও ব্যাংকটির নানা অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ উত্থাপন করেন। ইউসিবি’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বাবা চট্টগ্রামের প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী। শুরু থেকে ব্যাংকটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এম এ হাসেম।
বেসরকারি খাতের অন্যতম ন্যাশনাল ব্যাংকের মালিকানা সিকদার গ্রুপের হাত থেকে তুলে দেয়া হয় এস আলম গ্রুপের হাতে। এই ব্যাংকটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বিএনপি’র অন্যতম ব্যবসায়ী নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টু। আওয়ামী লীগের সময় বিভিন্ন চাপে ব্যাংকটির মালিকানা থেকে সরে যেতে বাধ্য হন মিন্টু। এখন আবার তারা মালিকানায় ফেরার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, চাকরিচ্যুত কর্মকর্তাদের পুনর্বহালের দাবিতে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডারদের একটি গ্রুপ এবং সিটি ব্যাংক ও মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে বিক্ষোভ করেছেন কর্মকর্তারা। এ ছাড়া অসন্তোষ দেখা দিয়েছে ওয়ান ব্যাংকে। এ ছাড়া বুধবার রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকে বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তারা বিক্ষোভ করেন।
ওদিকে দেশের রাজস্ব আদায়ের প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। তিনি প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। তার পদত্যাগের দাবিতে বুধবার দিনভর বিক্ষোভ করেছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা।
বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সাবেক জয়নুল বারী। কিন্তু তিনি অফিস করছেন না। রোববার আইডিআরএ’র কর্মকর্তারাও বিক্ষোভ করেছেন।
ফলে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে শীর্ষ কর্তা না আসায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সংস্থার প্রধানরা অফিসে না আসায় কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছুটি ছাড়া নিজের ইচ্ছায় অফিসে না আসা শৃঙ্খলা ভঙ্গ। আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারণী এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে দক্ষতার চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্যকে একমাত্র যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল হক বলেন, এস আলম গ্রুপ আমানতকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা নামে- বেনামে তুলে পাচার করেছেন। ফলে শুধু এসআইবিএল নয়, পুরো আর্থিক খাতই হুমকির মুখে পড়েছে। সাধারণ আমানতকারীরা জমাকৃত অর্থ প্রয়োজন অনুযায়ী তুলতে পারছেন না। এস আলম গ্রুপের ‘কবল থেকে দখলমুক্ত’ করে প্রকৃত মালিক ও প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তাদের কাছে ব্যাংকটির মালিকানা হস্তান্তরের দাবি জানান তিনি।