ইতিহাস ঐতিহ্য

ঐতিহাসিক সোনাভানের নগরী টঙ্গী

  প্রতিনিধি ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ৮:৩৪:৪৪

১৮২৫ সালের টঙ্গী সেতুর একটি ধাতব চিত্র।

শেয়ার করুন

রাজধানী ঢাকার অতি নিকটবর্তী গাজীপুর মহানগরের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত টঙ্গী শিল্প নগরী। যা পুথি কাব্যের নায়িকা সোনাভানের সেই কহর দরিয়ার তীরে অবস্থিত। যে কহর দরিয়ার বর্তমান নাম তুরাগ নদ। যার গুরুত্ব এখন গোটা মুসলিম দুনিয়ায় ছড়িয়ে আছে বিশ্ব ইজতেমার মাধ্যমে। টঙ্গী শব্দটি ভূ-উৎপত্তিগতভাবে ‘টাঙ্গী’ শব্দ থেকে এসেছে। কথিত আছে, বর্তমান পাকিস্তানের ‘টাঙ্গী’ নামক স্থান থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে সৈয়দ শাহ সুফি বোরহান উদ্দিন নামক এক বুজুর্গ আলেম এসেছিলেন এই সোনাভানের শহর কহর দরিয়ার পাড়ে। উক্ত বুজুর্গ দরবেশের স্থানটি ভালো লাগায় এখানেই তিনি তার বসবাসের আস্তানা স্থাপন করেন। বোরহান উদ্দিন দরবেশ তাঁর অবস্থান ব্যক্ত করার জন্য সবসময় নাকি বাঁশের লাঠির মাথায় একটি ঝুলনা উপরে ঝুলিয়ে বা টাঙিয়ে রাখতেন। কথিত আছে যে, ঝুলনা টাঙ্গানোর কারণে তাঁকে ‘টাঙ্গীওয়ালা’ দরবেশ বলে ডাকা হতো। আবার অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, ‘টাঙ্গী’ নামক স্থান থেকে আসার কারণে তাঁকে সবাই ‘টাঙ্গীওয়ালা’ বলে ডাকত। আসলে ‘টাঙ্গী’ শব্দ থেকে ‘টাঙ্গীওয়ালা’ শব্দের উৎপত্তি। ‘টাঙ্গী’ শব্দের অপভ্রংশই ‘টঙ্গী’। পুথি শাস্ত্রে সোনাভানের কথা একাধিকবার উঠে এসেছে। পুথি কাব্যবিদ গরীবুল্লাহ ও ফয়জুল্লাহ উল্লেখ করেছেন যে, সোনাভান ছিলেন এই কহর দরিয়ার পরগনার জমিদার। শক্তিশালী, বুদ্ধিমতী, সুন্দরী এবং বহুগুণের অধিকারিণী ছিলেন সোনাভান। তার এসব গুণের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল সুদূর আরব পর্যন্ত। মহানবী (সা.) এর বংশধর বীর আবু হানিফা তাঁর শক্তি পরীক্ষার জন্য যুদ্ধ করতে এসেছিলেন এই তুরাগ নদে অর্থাৎ কহর দরিয়ার তীরে।১৯৬৫ সালে বিশ্ব ইজতেমার মাধ্যমে গোটা মুসলিম দুনিয়ার পরিচিতি লাভ করে টঙ্গী।

সোনাভানের পুথির সংক্ষেপনটা এমন… সোনাভান কহরদরিয়ার (কষ্টের নদী) তীরে টঙ্গী শহরের শাসনকর্তা এক রাজকন্যা। পেশীশক্তি, যুদ্ধবিদ্যা, জাদু ও ভক্তিবিদ্যা এবং বুদ্ধিমত্তায় তিনি অনন্য। সে সময়ের পুরুষগণ সহজেই তার সাথে যুদ্ধে পরাজিত হতেন; এই অহংকারে তিনি অবিবাহিত ছিলেন এবং ঘোষণা জারি ছিল: ‘যে পুরুষ সোনাভানকে যুদ্ধে পরাজিত করবে সোনাভান তাকে বিয়ে করবেন।’ ঐতিহাসিক হযরত আলীর পুত্র আবু হানিফিয়া স্বপ্নে আল্লাহর নির্দেশনা পান সোনাভানকে পরাজিত করবার জন্য। এই উদ্দেশে তিনি কহরদরিয়ার তীরে টঙ্গী শহরে আসেন এবং তিনবারের চেষ্টায়ও সোনাভানকে পরাজিত করতে পারেন না। প্রথমবার পরাজয়ের পর সোনাভান হানিফ পালোয়ানকে মদিনায় ছুঁড়ে ফেলেন। দ্বিতীয়বারের যুদ্ধে মেরে ভূমিতে ফেলে রাখেন, আলী দলবল নিয়ে এসে পুত্রকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। তৃতীয়বারের যুদ্ধে হানিফকে মেরে সিন্দুক বন্দি করে কহরদরিয়ার জলে ছুঁড়ে ফেলেন; সেখানে পানির পির খোয়াজ খিজির তাকে উদ্ধার করে। পরবর্তীতে হযরত আলী মল্লিকা সমর্ত্তভান আর জৈগুনকে দায়িত্ব দেন সোনাভানকে পরাস্ত করতে, অবশেষে সোনাভান পরাজিত হয় এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মদীনায় চলে যান।

পুথির ঘটনাক্রম, সময় ও ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে নানাবিধ জটিলতা থাকলেও সেখানে দৃশ্যমান হয়েছে পুথিকারদের সময়ের সমাজ ও ধর্মীয় ভাবনা। ইতিহাসের মুহাম্মদ ইবনে হানিফিয়া (হানিফ পালোয়ান) হযরত আলীর পুত্র, হাসান-হোসেনের ভাই যদিও তিনি মোহাম্মদ-কন্যা ফাতেমার পুত্র নন। হানিফিয়ার মায়ের নাম পুথিমতে ‘বিবি হনুফা’, ইতিহাসমতে হানিফিয়ার মায়ের নাম ‘খাওলা বিনতে জাফর’। হযরত আলী তাঁর নাহাজ আল-বালাগা বইয়ে হানিফিয়া সম্পর্কে বলছেন- ‘এ হচ্ছে আমার পুত্র আর ওরা দু’জন আল্লাহর রাসূলের পুত্র।’ সকল যুদ্ধে হযরত আলী হাসান-হোসেনকে পেছনে রেখে হানিফিয়াকে সম্মুখভাগে রাখতেন, এ প্রসঙ্গে হানিফিয়া বলেন- ‘আমি তার দক্ষিণ হস্ত এবং তারা তার চক্ষু। সুতরাং তিনি তার চক্ষুকে দক্ষিণ হস্ত দ্বারা রক্ষা করেন।’ পুথির হানিফের সাথে ঐতিহাসিক মুহাম্মদ ইবনে হানিফিয়ার বেশ অমিল। পুথিকাররা ঐতিহাসিক সত্য নির্মাণের চেয়ে তাদের সাহিত্য, প্রেম ও ভক্তি ভাবনাকেই দৃশ্যমান করেছেন রচনা ও উপস্থাপনার মধ্যে অধিকতর। মনে রাখতে হবে যে, সোনাভানকে নিয়ে উপস্থাপিত পুথিসমূহ মুসলমানদের রচিত এবং এখানে বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক আচরণই প্রকাশ পেয়েছে প্রবলভাবে।

বাংলা সাহিত্যের পুথিতে ‘বন্দনা’ উপস্থাপনের মাধ্যমে পাঠ-রচনা আরম্ভ হয় এবং ক্রমশ একটি পূর্ণাঙ্গ গল্পকে প্রকাশ করে সমাপ্ত হয়। এই বন্দনায় স্রষ্টা থেকে শুরু করে পিতা, মাতা, প্রকৃতি, শিক্ষাগুরু, পৃষ্ঠপোষক এবং রচয়িতা-উপস্থাপকের নাম থাকে। সোনাভানের পুথিও তার ব্যতিক্রম নয়। মধ্যযুগের পুথি-রচনায় ‘স্বপ্ন’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে; পর্যালোচনা করে দেখা যায়- রচয়িতা, উপস্থাপক, নায়ক-নায়িকা, শ্রোতা-দর্শক (পাঠ) আয়োজক, পৃষ্ঠপোষক স্বপ্নের মাধ্যমে দৈব আদেশ পেয়ে পুথি-রচনা-উপস্থাপনা-পৃষ্ঠপোষকতা (পাঠ) আয়োজনের কাজে নিয়োজিত হন। পুথির গল্পে চরিত্র সমূহের গতি ও পথ নির্মাণে স্বপ্ন-দৈববাণী প্রায়শই মূল ভূমিকা পালন করে। সোনাভানের পুথিতে ইসলাম ধর্মের আল্লাহ গল্পের প্রধান পুরুষ চরিত্র হানিফাকে নির্দেশ দেন সোনাভানকে পরাজিত করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে। পুথির শুরুতে সোনাভানের শক্তির মাহাত্ম্য প্রকাশ পায়; সেখানে (তার রাজ্যে) তিনি শোষক কিংবা অত্যাচারী ছিলেন কি না এ জাতীয় কোনো ইঙ্গিত নেই; আছে সোনাভানের অহংকারের কথা। হানিফা তার পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বহুপথ ভুল করে কহরদরিয়ার তীরে টঙ্গী শহরে সোনাভানের নগরে এসে পৌঁছান, এক বৃদ্ধার বাজারের পথ রুদ্ধ করে প্রলোভন দেখিয়ে বৃদ্ধার মাধ্যমে সোনাভানের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। বিয়ের প্রস্তাব বহনকারী বৃদ্ধাবুড়িকে সোনাভানের নির্দেশে প্রহার করে মাথার চুল কেটে দেওয়া হয়। এই ঘটনায় শিব ও কালীভক্ত সোনাভানের অহংকার ও ধর্মীয় সচেতনতার পাশাপাশি হানিফ পালোয়ানের বীরত্বের ঘাটতি দৃশ্যমান হলেও হানিফিয়া প্রেমিক সত্তা এবং আল্লাহর প্রতি ইমানের দৃঢ়তা প্রকাশ পায়।

সোনাভান হানিফার প্রস্তাব নাকচ করে দিলে আলাদা সময়ে তিনবারের যুদ্ধে হানিফা পরাজিত হয়ে সোনাভানকে জয় করতে ব্যর্থ হয়। সোনাভান পরাজিত যোদ্ধা হানিফাকে বলীর মাধ্যমে হত্যা করতে চাইলে হিন্দুধর্মের দেবতা শিব জানান- সোনাভান শক্তিশালী বীর হযরত আলীর পুত্রকে হত্যা করতে পারবে না এবং এই বলী তারা গ্রহণ করবেন না। হযরত আলী সম্পর্কে শিবের এই দৃষ্টিভঙ্গি বাঙালি মুসলমানের দেখাকে নির্দিষ্ট করে এবং বাংলায় হিন্দুধর্মের প্রভাব কাটিয়ে মুসলমানদের প্রভাবকে দৃশ্যমান করে। সোনাভান হানিফিয়াকে আহত করে সিন্দুকে ভরে নদীতে ফেলে দিলে পানির পির খোয়াজ খিজির এসে হানিফিয়াকে রক্ষা করে তার পারিবারিক বীরত্ব ও ঐতিহ্যের গুণে। অর্থাৎ কোনোভাবেই (পেশী ও বুদ্ধির দ্বারা) হানিফিয়ার ক্ষমতা ছিল না সোনাভানকে জয় করবার। এক সময় মল্লিকা সমর্ত্তভান ও জৈগুনের সাথে যুদ্ধে পরাজিত সোনাভানের মতের পরিবর্তন হয়। সোনাভানের পুথিতে হানিফিয়ার যোগ্যতা নয় বরং তার পারিবারিক ঐতিহ্য, ইসলাম ধর্মের রাসূল মোহাম্মদ (সাঃ)-এর নাতি পরিচয়, আলী-ফাতেমার পুত্র পরিচয়, হাসান-হোসেনের ভাই পরিচয় হানিফাকে জয় (সোনাভানকে) এনে দেয়। এখানে নায়কের ভূমিকার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ইসলামের সামাজিক ও মুসলমানদের মনস্তাত্ত্বিক ঐতিহ্য। রামায়ণে যেভাবে রামের পক্ষে, মহাভারতে যেভাবে অর্জুনের পক্ষে দৈবশক্তি কাজ করেছে সোনাভানের পুথিতে ক্রিয়াশীল ছিল হযরত আলীর মাহাত্ম্য ও পরিচিতি। বীর আলী একজন নারীর সাথে যুদ্ধে গেলে সেটা বীরত্বের ঘাটতি বিবেচনা করে হযরত আলী, মল্লিকা সমর্ত্তভান ও জৈগুনকে পাঠালেন এবং চুলের মুঠি ধরাধরির যুদ্ধে তারা সফল হলেন। হানিফার জয় হলো।

নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে উদ্ধার হওয়া বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে বৌদ্ধ সহজিয়াদের উপস্থিতি এবং সে সময়কার বাংলা অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সরবতা ও প্রান্তিক জনজীবনের সংস্কৃতি বিদ্যমান রয়েছে। পরবর্তীতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বাংলা অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করে; যার নিদর্শন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য ইত্যাদি। এভাবে বাংলা অঞ্চলের সাহিত্যে বাংলা অঞ্চলের রাজনৈতিক পথ-পরিক্রমা, ক্রিয়া, দর্শন, সামাজিক মনস্তত্ত্ব প্রকাশ পায়। মুসলমানদের আগমন ও বিস্তারে বাংলা সাহিত্যে মুসলমানিত্বের ছাপ স্পষ্ট হয়। ইংরেজদের রাজনৈতিক সুবিধা বাস্তবায়ন ও বাইবেল প্রচারের লক্ষ্যে বাংলা অঞ্চলে ছাপাখানা ক্রিয়াশীল হবার সুবিধা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষকগণের পাশাপাশি মুসলমান, খ্রিষ্টান, হিন্দুরা নিতে থাকেন; কেউ আগে, কেউ পরে। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, সোনাভানের পুথি জালাল ফকির, মুন্সী আব্দুল করিম, ফকির গরীবুল্লা, ছৈয়দ হামজা কর্তৃক রচিত-ছাপানো এবং বাঙালি মুসলমানদের মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে। পুথিতে হিন্দুধর্মের অনুসারী সোনাভানকে ইসলামিকরণের মাধ্যমে বাংলায় মুসলমানদের প্রভাব ও নতুনত্ব বেশি প্রকাশিত হয়েছে।

টঙ্গী বাজার বর্তমান ব্রিজের পশ্চিম পাশে কিংবদন্তি পুথি শাস্ত্রের নায়িকা সোনাভানের বসতভিটার ধ্বংসাবশেষ আছে। যেখানে বর্তমান সড়ক ও জনপথের টঙ্গী উপবিভাগ প্রকৌশলীর অফিস বিদ্যমান। সোনাভানের বসতঘরের ভিটায় ছোট ছোট ইটের দেয়ালে ১টি বটবৃক্ষ গজিয়েছিল, যা সোনাভানের স্মৃতির স্বাক্ষর বহন করত কিন্তু ২০০৮-২০০৯ সালে সওজের অফিস ভবনটি নির্মাণকালে সোনাভানের রেখে যাওয়া সব স্মৃতি ধ্বংস করে ফেলে। পশ্চিম পাশে শান বাঁধানো দীঘি এখনো স্মৃতি বহন করছে। সোনাভানের বসতভিটার পশ্চিম পাশে বোরহানউদ্দিন দরবেশের মাজার আছে। যেখানে সারা দিন ভক্ত আশেকান, আলেমরা মাজার জিয়ারত করে থাকেন। কিন্তু বস্তিবাসীদের অনধিকার প্রবেশের কারণে মাজারের পবিত্রতা বিনষ্ট হচ্ছে। ১৯৬০-এর দশকে তৎকালীন ডিআইটি ২২০ একর জমি ও বাড়িঘর হুকুম দখল করে ক্ষুদ্র এবং বৃৃহদায়তন শিল্পনগরী বানানোর জন্য। পরিণত হয় টঙ্গী শিল্পনগরী।

গ্রন্থ-নির্দেশিকা:

১। সোনাভানের পুথি, জালাল ফকির কর্তৃক রচিত, প্রকাশকাল: জুলাই ১৮৮৫। (মুসলমানি ছাপা পুথির বিবরণ, সংগ্রহ সংকলন ও সম্পাদনা: মোহাম্মদ আবদুল কাইউম, প্রথম প্রকাশ: ২০১৮, প্রকাশক: মধ্যমা।

২। ছহি বড় সোনাভান, ছৈয়দ হামজা মরহুম সাহেব, প্রকাশক: শ্রীযুক্ত ওলি উল্লা মিঞা (মতওল্লী চওক মছজিদ, ঢাকা) প্রিন্টার শ্রী হামিদর রহমান খাঁ দ্বারা মুদ্রিত, সন: ১৯১৭

৩। শুনাভানের পুঁথি, মুন্সী আব্দুল করিম, উৎস প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৯, আইইএসভিএন ৯৮৪৭০০৫৯০২০৩৩

৪। নাহজ আল-বালাগা, আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালিব, র‍্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা ৩য় প্রকাশ, পৃষ্ঠা- ৫৭


শেয়ার করুন

আরও খবর

Sponsered content