বাংলাদেশের দক্ষিণের দ্বীপজেলা ভোলায় ৫ দশমিক ১০৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) উত্তোলনযোগ্য গ্যাস মজুদের সন্ধান পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড ও রাশিয়ার জ্বালানি জায়ান্ট গ্যাজপ্রমের এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ১ লাখ কোটি ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস দেশের বার্ষিক চাহিদা পূরণ করতে পারে।
গবেষণার আওতায়, শাহবাজপুর থেকে ইলিশা পর্যন্ত ৬০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় একটি ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ (থ্রি-ডি সাইসমিক সার্ভে) করা হয়, যেখানে ২ দশমিক ৪২৩ টিসিএফ গ্যাস পাওয়া যায়। চর ফ্যাশনে আরেকটি ১৫২.৬ লাইন- কি.মি. দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপের তথ্যে ২ দশমিক ৬৮৬ টিসিএফ গ্যাস মজুদের সন্ধান পাওয়া গেছে বলে বাপেক্স জানিয়েছে।
২০২০ সালে শুরু হওয়া এই যৌথ গবেষণা চলতি ২০২৪ সালের জুনে শেষ হয়। গবেষণার ফলাফল বা তথ্য জমা দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ অয়েল, গ্যাস অ্যান্ড মিনারেল কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা) ও বাপেক্স- এ।
গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, ১০ শতাংশ সম্ভাবনায় শাহবাজপুর ও ইলিশায় ২ দশমিক ৪২৩ টিসিএফ, এবং চর ফ্যাশনে ২ দশমিক ৬৮৬ টিসিএফ মজুদ গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। যা মোট ৫ দশমিক ১০৯ টিসিএফ গ্যাস। উত্তোলনযোগ্য ৫ দশমিক ১০৯ টিসিএফ গ্যাসের দাম – বর্তমান স্পট মার্কেট এলএনজির দর ১০.৪৬ মার্কিন ডলার প্রতি এমএমবিটিইউ হিসাবে প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা।
এছাড়াও ৫০ শতাংশ সম্ভাবনায় ঐ লোকেশনে ৩ দশমিক ৩৯১ টিসিএফ, এবং ৯০ শতাংশ সম্ভাবনায় সর্বনিম্ন ১ দশমিক ৮০৯ টিসিএফ গ্যাস পাওয়া যাবে।
বাপেক্স এর সাবেক মহাব্যবস্থাপক (ভূতাত্ত্বিক বিভাগ) আলমগীর হোসেন দ্য বিজনেস স্টাডার্ডকে বলেন, 'বাস্তবে ৫ টিসিএফ থেকেও বেশি গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ অতীতে আমরা এসব লোকেশানে ২ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলনের স্টাডি নিয়ে কাজ করলেও – পরে গিয়ে ওই জায়গায় ৩ থেকে ৪ টিসিএফ পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করতে সক্ষম হয়েছি।'
১৯৯৮ সালে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের পরে এটিই সবচেয়ে বড় গ্যাস মজুতের আবিষ্কার। শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রটি ১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি আবিষ্কৃত হলেও– সাম্প্রতিক গবেষণার আগপর্যন্ত এটিকে একটি ছোট গ্যাসক্ষেত্র হিসেবেই ধরা হতো।
গবেষণায় অংশ নেওয়া একজন গবেষক ও নরওয়ের বহুজাতিক জ্বালানি কোম্পানি স্ট্যাটঅয়েল (বর্তমানে ইকুইনর) এর প্রতিনিধি টিবিএসকে বলেন, 'ভূকম্পন জরিপ, অয়েল লক, কোর স্যাম্পল তথ্যের ভিত্তিতে এবং সুপারকম্পিউটার ও উন্নতমানের পরীক্ষাগারের মাধ্যমে পরিচালিত এই গবেষণা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করতে পেরেছে। 'এসব পদ্ধতি নিশ্চিত করে যে এর ফলাফল নির্ভরযোগ্য। এই গবেষণার ভিত্তিতে যদি এখন (গ্যাসক্ষেত্র) উন্নয়ন প্রকল্প এগিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদার একটি বড় অংশই তারা পূরণ করতে পারবে।'
তিনি আরও বলেন, 'ভোলায় অন্তত ৪৯টি নতুন কূপ খনন করলে– বাসাবাড়ি ও সিএনজির গ্যাস সংকটের সমাধান হবে, যা মূল্যস্ফীতি কমার সহায়ক হবে, পণ্যের দাম কমাবে।'
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার টিবিএসকে বলেন, 'গ্যাসের অনুসন্ধান ও জরিপের জন্য রাশিয়ার গ্যাজপ্রমের সাথে আমাদের একটি এমওইউ (সমঝোতা স্মারক) রয়েছে। ভোলা অঞ্চলের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। ভোলা থেকে বরিশাল এবং তারপর বরিশাল থেকে খুলনা পর্যন্ত পাইপলাইন বসিয়ে আমরা ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার পরিকল্পনা করছি।
'এলএনজি ও সিএনজি করে এই গ্যাস ঢাকায় সরবরাহের লক্ষ্য রয়েছে আমাদের। খুব শিগগিরই এসব প্রকল্পের জন্য দরপত্র দেওয়া হবে, যেখানে বিভিন্ন কোম্পানিকে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ করা হবে। এভাবে আমরা এলএনজি আমদানি কমিয়ে – স্থানীয় গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে চাই' - যোগ করেন তিনি।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে ভোলায় পাঁচটি কূপ দিয়ে দৈনিক ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি) গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। আরও চারটি কূপ খনন করে রাখা হয়েছে। সেখান থেকেও দৈনিক আরও ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যাবে। এছাড়া, আরও পাঁচটি কূপের প্রস্তাবনা দেওয়া আছে, সেখান থেকেও আগামী দুই বছরের মধ্যে দৈনিক ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যাবে। এ ছাড়াও আরও ১৪টি কূপের স্থান শনাক্ত করা হয়েছে। যা থেকেও আরও ২১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব।
চর ফ্যাশনে ছয়টি ভূত্বাত্তিক কাঠামো শনাক্ত করা হয়েছে। যেখানে ৩০টি কূপ খনন করা যেতে পারে। এই কূপগুলো থেকে দৈনিক ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যেতে পারে।এসব কূপ চালু হলে, ভোলায় গ্যাসের দৈনিক উৎপাদন পৌঁছতে পারে ৯২০ মিলিয়ন ঘনফুটে। এতে চলমান গ্যাস সংকটের অনেকটাই লাঘব হবে, নির্ভরতা কমবে ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানিতে।
ভূতাত্ত্বিক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, 'ভোলা ও সিলেট আমাদের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় গ্যাস-সমৃদ্ধ অঞ্চল। আমাদের ভোলায় কূপ খননের কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে হবে, এবং গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।'
তবে অনুসন্ধান কার্যক্রমের জন্য পুরোপুরি বাপেক্সের ওপর নির্ভর না করার পরামর্শ দেন, কারণ কোম্পানিটির সক্ষমতা এখনও বাড়ার মধ্যে আছে। তার মতে, 'স্থানীয় গ্যাস উত্তোলন বাড়াতে পেট্রোবাংলার সাথে বিদেশি কোম্পানিগুলোর যৌথ অনুসন্ধানের উদ্যোগই বেশি কার্যকরী হবে।'
বাংলাদেশে এক দশকের বেশি সময় ধরে কার্যক্রম পরিচালনা করছে গ্যাজপ্রম। এসময়ে তারা ২০টি কূপ খনন করেছে, যার মাধ্যমে সাড়ে ৪ টিসিএফ গ্যাস আবিষ্কৃত রিজার্ভে যোগ হয়েছে। এসব কূপের দৈনিক ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করতে পারে।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা উল্লেখ করেন, ভোলার গ্যাসক্ষেত্রগুলো ৩০ বছর আগে আবিষ্কৃত হলেও – অর্থনৈতিক কারণে পাইপলাইন নির্মাণের কাজ বিলম্বিত হয়। এখন আবিষ্কৃত রিজার্ভ বাড়ায়– এগোচ্ছে পাইপলাইন নির্মাণকাজ। বর্তমানে স্থানীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র ও ক্ষুদ্র শিল্পগুলোতে সীমিত পরিমাণে ভোলার গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে।
দেশের দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তবে সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ২ হাজার ৬৩৩ মিলিয়ন ঘনফুট। এতে দৈনিক ঘাটতি থাকছে ১ হাজার ৩৬৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এই ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশকে ব্যাপকভাবে এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
তবে গত তিন মাস ধরে সামিটের ভাসমান এলএনজি টার্মিনালগুলোর একটি বন্ধ থাকায়– এলএনজি সরবরাহ নেমে আসে দৈনিক মাত্র ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটে। এতে দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্পকারখানায় গ্যাস সংকটের আরো অবনতি হয়।
সম্পাদকঃ মাহবুবা আক্তার। অফিসঃ ৭৫ ই-ব্রডওয়ে,নিউইয়র্ক এনওয়াই ১০০০২।ফোন:+৮৮০১৭১২৯০৩৪০১ ই- মেইলঃ dailyhaquekotha@gmail.com
প্রকাশিত সংবাদপত্রের অংশ