প্রতিনিধি ২ নভেম্বর ২০২৪ , ৪:১৩:১১
সরকার নানামুখী উদ্যোগ নেওয়ার পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ঘাটতি, গার্মেন্টেসের ঝুটসহ কারখানা সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও বেতন-ভাতা সংক্রান্ত নানা সমস্যায় কাটছেই না শিল্প খাতের অস্থিরতা।
গোয়েন্দারা বলছেন, এর নেপথ্যে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র এবং সদ্য ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্ধন রয়েছে। এছাড়া গ্যাস-বিদ্যুৎ ও কাঁচামাল সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হওয়া এবং দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগে বিপুল সংখ্যক শিল্পমালিকের ব্যাংক হিসাব জব্দের কারণে ব্যবসা গুটিয়ে যাওয়াও এখাতে অস্থিরতা সৃষ্টির বড় কারণ।
শিল্প খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ধারণা, তৈরি পোশাক কারখানাসহ উৎপাদনমুখী অন্যান্য শিল্পের অস্থিরতা কাটিয়ে দ্রæত স্থিতিশীল পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে এখন অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। দ্রæত এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে না পারলে দেশে বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে। একই সঙ্গে আরও ভয়ঙ্করভাবে শ্রমিক অসন্তোষ ও উৎপাদন ঘাটতির কারণে দেশি উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিগত সরকারের সুবিধাভোগীরা এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক মাঠও উত্তপ্ত করে তুলতে পারে। এতে বিভিন্ন শিল্পের, বিশেষ করে পোশাক খাতের বৈদেশিক অর্ডার ভারতসহ অন্যান্য দেশে চলে যেতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা।
এদিকে সরবরাহ না বাড়ায় দেশে গ্যাস সংকট বেড়েই চলছে। দিনে গ্যাসের ঘাটতি প্রায় ১৩৫ কোটি ঘনফুট। গ্যাস স্বল্পতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত খাত হচ্ছে শিল্প। চাহিদার চেয়ে ৩০ শতাংশ কম গ্যাস পাচ্ছে শিল্পকারখানা। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, চট্টগ্রাম, নরসিংদীসহ দেশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে এই সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। শিল্পমালিকরা জানান, ভোগান্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, কারখানা চালু রাখার চেয়ে বন্ধ রাখলেই লাভ।
গ্যাস সংকটে ব্যাহত হচ্ছে কারখানার উৎপাদন। অনেক কারখানা হুমকিতে, আবার কোনোটি বন্ধের পথে। বাধ্য হয়ে শ্রমিক ছাঁটাই করছেন মালিকরা। উৎপাদন কম হওয়ায় কমছে পণ্য রপ্তানি, বিদেশ থেকে বাড়ছে কাঁচামাল আমদানি। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়ছে। গ্যাস সংকটের দ্রত সমাধান না হলে অর্থনীতিতে অশনিসংকেত দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
শিল্পমালিকরা জানান, কারখানায় এমনিতেই গ্যাসের চাপ থাকে না। এখন তা আরও কমে গেছে। বিশেষ করে গাজীপুর, কোনাবাড়ী, কাশিমপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের চাপ নেই বললেই চলে। গ্যাস সংকটে প্রতিদিন তাদের বিপুল লোকসান গুনতে হচ্ছে। বিকল্প উপায়ে কারখানা চালু রাখতে হচ্ছে বাড়তি খরচ। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে শিল্প উৎপাদন গভীর সংকটে পড়বে। ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। শিল্পকারখানা বন্ধ হলে কিংবা বেতন দিতে না পারলে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে যাবেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তিগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাক খাত অন্যতম। জিডিপিতে অবদান ও কর্মসংস্থান তৈরিতে বিশেষভাবে ভূমিকা রাখছে রপ্তানিমুখী এ খাতটি। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডবিøউটিও) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর বাংলাদেশ ৩ হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল সাড়ে ৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। অথচ রাজনৈতিক অস্থিরতা, সরকার পতন ও সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষের জের ধরে দেশের তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশের একটি বড় অংশ বিভিন্ন দেশের বাজারে চলে গেছে, যা চরম উদ্বেগের। এতে দেশের অর্থনীতি বড় ধাক্কা খাবে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, অবাধে অর্থ পাচার, ব্যাংক খাতে লাগামহীন দুর্নীতি, ব্যাপক মূল্যস্ফীতি ও একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশের অর্থনীতিকে খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে। এ দুঃসময়ে তৈরি পোশাকের মতো রপ্তানিমুখী খাতে নানামুখী অস্থিরতায় বিপর্যয় সৃষ্টি হলে জাতীয় অর্থনীতি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে দেশে বেকারত্বের বোঝা আরও বাড়বে, বৃদ্ধি পাবে অসন্তোষ। তাই এ ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে কারা তা সরকারকেই দ্রত খুঁজে বের করতে হবে।
শিল্প মালিকরা বলেন, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর শিল্প জোনগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্ব›েদ্বর শিকার হয়েছে পোশাক খাত। আইনশৃঙ্খলা সমন্বয়েও ঘাটতি ছিল। এছাড়া শ্রমিক নেতা, রাজনৈতিক দল, বাইরের ইন্ধনসহ বিভিন্ন ইস্যু আছে। সরকার কঠোর হাতে এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী না হলে অস্থিতিশীলতা আরও বাড়বে। তাদের ভাষ্য, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে কোন একটি পক্ষ চাচ্ছে না যে পরিস্থিতি শান্ত হোক। এতে রাজনৈতিক ইল-মোটিভও থাকতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা।
পোশাক খাতের একজন উদ্যোক্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, অস্থিরতা কেন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না সেটা তারা নিজেরাও বুঝতে পারছেন না। কিছু কারখানায় বেতন ভাতা সংক্রান্ত সমস্যা আছে, সেটা বিজিএমইএ দেখছে। এর বাইরে নানা কারণ দেখিয়ে হুটহাট সমস্যা তৈরি করা হচ্ছে। এর সঙ্গে শ্রমিকদের চেয়ে বাইরের লোকজন বেশি সম্পৃক্ত বলে মনে হচ্ছে। শিল্প খাতে অস্থিরতা সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা এবং এ ব্যাপারে আগাম তথ্য দিতে গোয়েন্দাদের ব্যর্থতা দূর করতে সরকারের আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
তবে শিল্প খাত পর্যবেক্ষকরা অনেকে মনে করেন, এ খাতে অস্থিরতা না কাটার নেপথ্যে কয়েকটি ইস্যু বড় ভূমিকা রাখছে। তাদের ভাষ্য, বিপুল সংখ্যক কারখানার মালিক সাবেক সরকারের সংশ্লিষ্ট লোকজন। সরকার পতনের পর তাদের একটি বড় অংশ আত্মগোপনে চলে গেছে। কেউ কেউ বিদেশে পালিয়েছে। যারা দেশে অবস্থান করছেন তারা অনেকে মামলা আতঙ্কে ভুগছেন। তাদের কারো কারো ব্যাংক হিসাব জব্ধ হওয়ায় কাঁচামাল ক্রয় থেকে শুরু করে উৎপাদন সংশ্লিষ্ট আনুষঙ্গিক খরচাদি পরিশোধে বিলম্ব হচ্ছে। এতে সেখানে এখন উৎপাদন সমস্যা তৈরি হয়েছে। ফলে অনেক কারখানা মালিকই সময়মতো মাসের বেতন পরিশোধ করতে পারছে না। আবার কিছু কারখানায় ব্যবসায় ভালো যাচ্ছিল না গত এক বছর ধরেই। সরকারের পটপরিবর্তনের পর এ সংকট আরও ঘণীভূত হয়েছে। ফলে সেখানে ২/৩ মাসের বেতন বকেয়া পড়েছে। এসব কারণে শ্রমিক অসন্তোষে ওইসব কারখানায় অস্থিরতা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে আগে সব বকেয়া বেতন ভাতা ঠিকমতো পরিশোধ করতে হবে। পাশাপাশি সরকারের পটপরিবর্তনের পর যেসব মালিক বা কর্তৃপক্ষ পালিয়ে গেছে তাদের বন্ধ কারখানা সচল রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা বিগত সরকারের মদদপুষ্ট এসব মালিকদের নিয়ন্ত্রণেই শিল্প খাতের একটি বড় অংশ। তাই তাদের বাদ দিয়ে শিল্প খাতের অস্থিরতা ঠেকানো অনেকটাই অসম্ভব।
এদের প্রসঙ্গে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, তারা নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং সুবিধা পেয়েছে এবং তাদের সঙ্গে আবার রাজনীতির একটা যোগাযোগ ছিল, সংযোগ ছিল। তা না হলে তারা এ রকম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এদের নিয়ন্ত্রণ এত বেশি এবং কয়েকজন মিলে একটা খাতকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এজন্যই এদেরকে বলা হয় ‘অলিগার্ক’।
প্রসঙ্গত, বেক্সিমকো এবং এস আলম শিল্পগোষ্ঠীর মালিকদের ব্যাংক হিসাব স্থগিত হওয়ায় কোম্পানির ব্যবসা পরিচালনায় সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এসব শিল্পগোষ্ঠীতে লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান রয়েছে। ফলে তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা চলছে। যদিও বেক্সিমকো গ্রæপের প্রতিষ্ঠানগুলো দেখাশোনার জন্য এরইমধ্যে একজন রিসিভার নিয়োগ করতে নির্দেশনা জারি করেছে আদালত।
অন্যদিকে এস আলম গ্রুপ ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সরকারের কাছে আর্থিক, সামাজিক ও আইনি সহায়তা চেয়ে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে হাজারো শ্রমিকের বেতন ভাতা পরিশোধে ব্যর্থ হলে শিল্প এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষের শঙ্কার কথা বলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, এলসি বাতিল করায় ভোগ্যপণ্য আমদানি ব্যাহত হচ্ছে, যা দেশে খাদ্য ও বস্তুগত সংকট তৈরি করতে পারে।
এদের প্রসঙ্গে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বলেছেন, প্রতিষ্ঠানগুলো অবশ্যই টিকিয়ে রাখতে চাই দেশের স্বার্থে। দেশের মানুষের স্বার্থে। কিন্তু এখানে কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তি জড়িত ছিল। যারা ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে মানি লন্ডারিং করেছে, ঋণ নিয়েছে, ঋণ খেলাপি হয়েছে। সেই ব্যক্তিদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। কিন্তু বড় বড় প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার শ্রমিক আছে, আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে তাদের ব্যাপারটাও ভাবতে হবে। তাদের জন্যও বিকল্প কর্মসংস্থানের কথা ভাবতে হবে। এবং এর প্রভাব জাতীয় অর্থনীতিতে কীভাবে পড়বে সেটাও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে।
প্রতিষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে শ্রম উপদেষ্টা জানান, মালিকানায় পরিবর্তন আনা এমনকি কিছু জাতীয়করণ করা যায় কি না সে চিন্তা-ভাবনা থেকে পর্যালোচনা চলছে। একটা প্রতিষ্ঠানে একাধিক মালিক থাকে। অনেক স্টেকহোল্ডার্স আছে। তাদের মধ্যে থেকে কাদের দায়িত্ব দিয়ে অথবা যদি প্রয়োজন বোধ করে শিল্প মন্ত্রণালয় জাতীয়করণ করতে পারে, কারণ শ্রমিকদের দিকটাও দেখতে হবে। এবং দেশের এইরকম পলিসিগত ডিসিশন এবং এর বাস্তবায়ন এটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এটা একদিনে পারা যাবে না। তাড়াহুড়ো করে সেটা করতে গেলে শিল্পের ক্ষতি করতে পারে। এবং শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ক্ষতি হবে। তৈরি পোশাক কারখানার মালিকরা জানান, ৫ আগস্টের পর গার্মেন্টস খাতে অস্থিরতার কারণে আনুমানিক ৪০০ মিলিয়ন বা ৪০ কোটি ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, এখনো অস্থিরতার কারণে গার্মেন্ট খাতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সেটি নিরূপণ সংক্রান্ত কার্যক্রম চলমান। তবে আমাদের কাছে আসা প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী ৪০০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, যা আরও বাড়তে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে নির্দিষ্ট কিছু শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতার কারণে শুধু সেপ্টেম্বর মাসে আমাদের ২৫০-৩০০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি ও উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের শিল্প ভালো নেই। বিশ্বে পোশাক আমদানি কমে আসছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-আগস্ট সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক আমদানি পরিমাণের দিক থেকে বেড়েছে ১.৫ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশ থেকে কমে গেছে ৩.৮ শতাংশ। কিন্তু চীন থেকে বেড়েছে ৩.৬ শতাংশ। একইভাবে ভিয়েতনাম থেকে বেড়েছে ৫.২ শতাংশ, ভারত থেকে বেড়েছে ৭.৬ শতাংশ এবং কম্বোডিয়া থেকে বেড়েছে ৭.৭ শতাংশ। ইউরোপে জানুয়ারি-জুলাই সময়ে মোট আমদানি বেড়েছে ৩.৩ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশ থেকে বেড়েছে মাত্র ২.৮ শতাংশ।