জাতীয়

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ

  প্রতিনিধি ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ , ৪:২৫:১৯

শেয়ার করুন

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের প্রভাবশালী পাইলট ছিলেন মনোয়ার হোসেন। বছর দশেক আগে অবসরে যান তিনি। যাওয়ার আগে নিয়োগ দিয়ে যান তার সন্তান ইশতিয়াককে। তিনি এখন সংস্থাটির সিনিয়র পাইলট। তিনিও বাবার থেকে কম নন। কয়েক বছর আগে বিমানে পাইলট নিয়োগের সময় তিনি তার ছেলে সাদিফ হোসেনকে চাকরি দেওয়ার বন্দোবস্ত করে ফেলেন।

মনোয়ার হোসেনের মতো অনেক পাইলটই তার স্বজনদের বিমানের পাইলটসহ অন্য পদগুলোতে নিয়োগে অনিয়ম করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এখনো সেই অনিয়মের নিয়োগ বলবৎ আছে। অন্তর্বর্তী সরকার তদন্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে।

ভিনি জুনিয়র জিতলেন ফিফা দ্য বেস্ট অ্যাওয়ার্ডভিনি জুনিয়র জিতলেন ফিফা দ্য বেস্ট অ্যাওয়ার্ড
বিমানসূত্র জানায়, স্বজনদের মাধ্যমে চাকরি পেয়েছেন ক্যাপ্টেন মনোয়ারের ছেলে ইশতিয়াক, ক্যাপ্টেন রফিকের ছেলে ফার্স্ট অফিসার জুনায়েদ রফিক, ক্যাপ্টেন নাছিমের ছেলে ফার্স্ট অফিসার ইসমাম, ক্যাপ্টেন বেলালের ছেলে ফার্স্ট অফিসার মুনিম, ক্যাপ্টেন মাকসুদের ছেলে ফার্স্ট অফিসার মুকতাদির, ক্যাপ্টেন কামাল মাহবুবের ছেলে ফার্স্ট অফিসার তাজিন মাহমুদ, ক্যাপ্টেন মফিদের ছেলে ফার্স্ট অফিসার মাসফিক, ক্যাপ্টেন মাজেদের ছেলে এ এইচ মেহেদী, ক্যাপ্টেন শোয়েব আলীর ছেলে জাহিদ, ক্যাপ্টেন শাহাবের ছেলে তাপস, ক্যাপ্টেন মফিদের ছেলে মাইনুল, ক্যাপ্টেন কামাল সাহিদের ছেলে ওয়াজিদ, ক্যাপ্টেন মারুফের ছেলে ওয়াজ, ক্যাপ্টেন রাফির ছেলে রাশেদ রাফি, ক্যাপ্টেন দোজার মেয়ে সাফা, ক্যাপ্টেন আশরাফের ছেলে আব্বাস, ক্যাপ্টেন নাজমুল হকের ছেলে সাজ্জাদ, ক্যাপ্টেন তেকাপের ভাই ফার্স্ট অফিসার ইরফান, ক্যাপ্টেন মুনতাসিরের ভাগ্নে ফার্স্ট অফিসার ইমতিয়াজ রেজা, ক্যাপ্টেন তানিয়ার দুই খালাত ভাই ফার্স্ট অফিসার আরমান ও ফার্স্ট অফিসার আবরার, ক্যাপ্টেন নোমানের ভাই ক্যাপ্টেন ফারিয়াল, ক্যাপ্টেন মুনতাসিরের ভাগ্নে ফার্স্ট অফিসার তাজিন মাহমুদ, ক্যাপ্টেন এনাম তালুকদারের ভাগ্নে ফার্স্ট অফিসার সারা, আরেক ভাগ্নে ফার্স্ট অফিসার নাদিম, ক্যাপ্টেন রফিকের ভাতিজা ক্যাপ্টেন আতিয়াব, ক্যাপ্টেন সাদাতের স্ত্রী ক্যাপ্টেন সুমাইলা, ক্যাপ্টেন ইমরানের স্ত্রী ক্যাপ্টেন আলেয়া, ক্যাপ্টেন জাহিদের স্ত্রী ক্যাপ্টেন ফারিয়াল ও ক্যাপ্টেন ইশতিয়াকের স্ত্রী ক্যাপ্টেন সাহানা।

 

গত ২৯ এপ্রিল বিমানে আবারও পাইলট নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয় সংস্থাটি। এতে বলা হয় ক্যাডেট পাইলট নিয়োগ হবে। অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে কমার্শিয়াল লাইসেন্স অর্থাৎ রেটেড পাইলট, যা বিজ্ঞাপনের পদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বর্তমান পাইলট ও স্বজনরা নিয়োগের জন্য আবেদন করেছেন বলে জানা গেছে। আবেদনকারীদের মধ্যে ক্যাপ্টেন ইশতিয়াকের ছেলে সাদিফ হোসেন, ক্যাপ্টেন কাদেরের স্ত্রী বুশরা সিদ্দিকা, ক্যাপ্টেন বেলালের ছেলে মোহাম্মদ শায়েখ, ক্যাপ্টেন হাসনাইনের মেয়ে শারমীন চৌধুরী ও আরেক ক্যাপ্টেনের মেয়ে তাসফিয়া ইকবাল রয়েছেন।

বিমানের এক পাইলট দেশ রূপান্তরকে জানান, ‘গত ১৫ বছরে এভাবেই পাইলট নিয়োগ হয়েছে। কোটি কোটি টাকার খেলা হয়েছে। লিখিত, মৌখিক ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়। পরীক্ষার সময় পরীক্ষক কিংবা সংশ্লিষ্টরা বুঝতে পারেন না কোন প্রার্থী কোন ক্যাপ্টেনের ছেলেমেয়ে। আমার জানা মতে, মন্ত্রণালয় বিষয়গুলোর তদন্ত করছে।’

 

সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানান, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে পাইলট নিয়োগে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। পাইলট নিয়োগে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইন লঙ্ঘন করাও হয়েছে। কর্মকর্তাদের স্বজনরা নিয়োগে সুবিধাও পেয়েছেন। রাজনৈতিক বিবেচনাও ছিল পাইলটসহ অন্যান্য নিয়োগে। প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও নিয়োগে হস্তক্ষেপ করেছেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাধ্য হয়েছেন এসব অনিয়মে সায় দিতে। পাইলট নিয়োগে স্বজনপ্রীতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর বিমানের জন্য চুক্তিভিত্তিক আটজন ক্যাপ্টেন ও ছয়জন ফার্স্ট অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়। এদের সাতজনই বাংলাদেশ বিমানের সাবেক পাইলট ছিলেন। তাদের একজনের বোয়িং ৭৭৭ বিমান উড্ডয়নের অভিজ্ঞতা ছিল। অন্য সাত জনের তিন জন বিমানের ক্যাপ্টেন ছিলেন। বাকি চার জনের বোয়িং-৭৭৭-৭৮৭, এয়ারবাস ৩৩০ চালানোর অভিজ্ঞতা থাকলেও ক্যাপ্টেনের অভিজ্ঞতা ছিল না। তারাও নিয়োগ পেয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিমান অনিয়মে ভরা। অতীতের সব সরকারের আমলেই অনিয়ম হয়েছে। পাইলট নিয়োগসহ প্রতিটি সেক্টরেই নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টি আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। প্রমাণ মিললে নিয়োগ বাতিলসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। বছর দুয়েক আগে পাইলটদের সংগঠন বাপা’র নির্বাহী কমিটি চিঠি দিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছিল কিন্তু প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’

বিমানসূত্র জানায়, পাইলট নিয়োগে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে কয়েকজন ভুক্তভোগী আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। বিমানের সিনিয়র বেশ কয়েকজন পাইলট অভিযোগ করেছেন, ক্যাপ্টেন ইশতিয়াকের ছেলের নিয়োগ ঠেকানোর শক্তি কারোরই ছিল না। সম্প্রতি নিয়োগ দেওয়া পাইলটদের ব্যাপারেও প্রশ্ন উঠেছে। বিগত পাঁচ দশক ধরে বিমানের ক্যাপ্টেন নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও অনিয়ম করা হয়েছে। বিমানে বর্তমানে পাইলট ১৭০ জন। তাদের ৬০ জনই কারও না কারও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। পাইলটের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি, ভাই-ভাতিজি, শ্যালক, ভগ্নিপতি, মামা-ভাগ্নে ও খালা-খালুরাও আছেন। বিমানের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এসব অনিয়ম চলছে।

পাইলটরা একটা ম্যানুয়েল তৈরি করে নিয়েছেন, যাতে তাদের আত্মীয়-স্বজনকে নিরাপদে, নির্বিঘ্নে পাইলট বানানোর সুযোগ থাকে। বিশ্বের যেকোনো এয়ারলাইনসেই পাইলট হতে গেলে বিজ্ঞানে উচ্চমাধ্যমিক (ম্যাথমেটিক্স ও ফিজিক্সসহ) পাস হতে হয়। কিন্তু পাইলট সাদিয়া এসবের কোনো তোয়াক্কাই করেননি। তিনি মানবিক শাখায় উচ্চমাধ্যমিক পাসের সনদ দিয়ে ঢুকে যান বোয়িং ৭৭৭-এর ফার্স্ট অফিসার হিসেবে। ২০২১ সালের ওই ঘটনা সিভিল এভিয়েশনের তদন্তে ফাঁস হওয়ার পর দেশে-বিদেশে আলোড়ন শুরু হয়। পরে বিমান থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়। সাদিয়ার স্বামী ক্যাপ্টেন সাজিদ তখন বিমানের গুরুত্বপূর্ণ (পাইলট প্রশিক্ষণ) শাখার দায়িত্বে ছিলেন।

পাইলট নিয়োগের বড় নজির গড়ে গেছেন সাবেক এমডি ক্যাপ্টেন মোসাদ্দেক। তিনি তার ভাতিজাকে পাইলট নিয়োগ দিতে গিয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতি ও অনৈতিক কাণ্ড করেছেন। দুদক এ ঘটনার সত্যতা পেয়ে চার্জশিটও দিয়েছে। তাতে চাকরি যাওয়ার পাশাপাশি মোসাদ্দেক জেলও খাটেন। মামলাটি এখন আদালতে বিচারাধীন।

জানা গেছে, ২০২২ সালে পাইলট নিয়োগে অভিযোগ ওঠায় একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি প্রতিবেদন দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিমানের তৎকালীন চিফ অব ট্রেনিং ক্যাপ্টেন সাজিদ আহমেদ পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বোয়িং-৭৭৭ ইআর-এ পাইলট সংকট ছিল। এ কারণে বিমান বাংলাদেশের ককপিট বা কেবিন ক্রু সংক্রান্ত বিমান পরিচালনা পর্ষদের বিশেষ সাব-কমিটির সভায় বিমানের প্রয়োজনীয় পদ প্লেসমেন্ট, পদোন্নতি বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। বিমানের অপারেশনাল ম্যানুয়াল পার্ট-ডি-এর ৩.৪.৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে বোয়িং-৭৭৭ বিমানের কো-পাইলট বা ফার্স্ট অফিসার হতে হলে যোগ্যতা হিসেবে একজন পাইলটের কমপক্ষে ৩০০ উড্ডয়ন ঘণ্টা থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বিজ্ঞাপনে এ শর্ত দেওয়া ছিল না। বাপাও এ নিয়োগ নিয়ে আপত্তি তোলে। তারা বলে, পাইলট নিয়োগে বিমানের অপারেশনাল নির্দেশনা ‍চুক্তি লঙ্ঘন করা হয়েছে। ফ্লাইট অফিসার পদে একজন এয়ারলাইনস ট্রান্সপোর্ট পাইলট ভুয়া সনদ জমা দিয়েছেন। তার সিমুলেটর প্রশিক্ষণ ছিল না। বোয়িং-৭৭৭-এর জন্য জ্যেষ্ঠ পাইলটদের পাশ কাটিয়ে এক জুনিয়র পাইলটকে পাইলটদের প্রশিক্ষক বানানো হয়েছে।


শেয়ার করুন