প্রতিনিধি ১০ মার্চ ২০২৪ , ৬:৫৫:৪৪
স্টাফ রিপোর্টারঃ শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীতে পানি না থাকায় উত্তরের পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ কৃষক সমিতি।
সংগঠনটির নেতাদের দাবি, গঙ্গা নদী পানি চুক্তি বিদ্যমান থাকলেও চুক্তি ভঙ্গ করে তিস্তা নদীর ওপর ভারতের গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশের প্রাপ্য পানি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এর ফলে তিস্তাসহ তিস্তা থেকে প্রবাহিত প্রায় ২৪টি নদী পানিশূন্যতায় মৃতপ্রায়। ভারত তিস্তা চুক্তি করার অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে চুক্তি করার বিষয়ে বারবার অনীহা প্রকাশ করছে। এ কারণে এখন শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা পানিশূন্য হয়ে পড়ায় উত্তরের পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে।
শনিবার (৯ মার্চ) দুপুরে রংপুর নগরীর শাপলা চত্বর বটতলায় অনুষ্ঠিত তিস্তা কৃষক সমাবেশে এসব কথা বলেছেন বাংলাদেশ কৃষক সমিতির নেতৃবৃন্দ। তিস্তা নদীর ন্যায্য হিস্যা আদায় ও বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচের পানি বিতরণে বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষের অনিয়ম, হয়রানি ও দুর্নীতি বন্ধের দাবিতে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশ থেকে কৃষি, কৃষক ও দেশ বাঁচাতে ৯টি দাবি তুলে ধরে তা বাস্তবায়নের জন্য সরকারসহ নদী কমিশনের প্রতি জোর দাবি জানানো হয়। এ সময় পূর্বনির্ধারিত স্থানে পুলিশ সমাবেশ করতে না দেয়ায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন কৃষক সমিতির নেতারা।
কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আলতাফ হোসাইনের সভাপতিত্বে ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবিদ হোসেনের সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন, সহ-সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হোসেন খান, নির্বাহী কমিটির সদস্য রাগীব আহসান মুন্না, রংপুর জেলা কমিটির সভাপতি আমজাদ হোসেন সরকার, সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন, গাইবান্ধা জেলা কমিটির সভাপতি সাদেকুল ইসলাম, ঠাকুরগাঁও জেলা কমিটির সভাপতি ইয়াকুব হোসেন, সাধারণ সম্পাদক মোর্তুজা আলম, কুড়িগ্রাম জেলা কমিটির সভাপতি নূর মোহাম্মদ আনসার, সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ কুমার রায়, দিনাজপুর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হাসান সিদ্দিকী, লালমনিরহাট জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মধুসূদন রায়, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট মহসিন রেজা, তাজুল ইসলাম প্রমুখ।
সংহতি বক্তব্য দেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি রংপুর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কমরেড কাফী সরকার।নদীনির্ভর উত্তরের পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বাঁচাতে জরুরি উদ্যোগ নেওয়ার বিকল্প নেই উল্লেখ করে নেতৃবৃন্দ বলেন, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের বিশেষভাবে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারীসহ অন্যান্য জেলার কৃষকসহ সাধারণ জনগোষ্ঠী এবং এসব জেলার পরিবেশ, প্রকৃতি, প্রাণ ও জীববৈচিত্র্য তিস্তা নদীর ওপর নির্ভরশীল। শুষ্ক মৌসুমে বিশেষভাবে ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত তিস্তা নদী প্রায় পানিশূন্য হয়ে শুকনো বালুর রাশিতে পরিণত হয়। এ সময়কালে নদী মাছশূন্য হয়ে যাওয়ার মৎস্যজীবীরা চরম সংকটের মুখোমুখি হয়। সেচের পানির অভাবে কৃষিজমি বিরাণভূমি হয়ে পড়ে। পরিবেশ, প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। বিগত অনেক বছর ধরেই এই অঞ্চলের কৃষকরা ফসল উৎপাদনে হিমশিম খাচ্ছে। কৃষি জমির জৈবশক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। ফসল উৎপাদনে উৎপাদন খরচ লাগামহীনভাবে বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু কৃষক তার ফসলের লাভজনক দাম পাচ্ছে না। এই অবস্থা চলতে থাকলে দ্রুতই দেশের খাদ্য নিরাপত্তা চরম হুমকির সম্মুখীন হবে।
কৃষক সমিতির নেতারা আরও বলেন, দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ফসল উৎপাদনের জন্য সেচ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে তিস্তা সেচ প্রকল্প চালু করলেও তিস্তার উৎস মুখে ভারত পানি আটকে রেখে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করায় তিস্তা সেচ প্রকল্প সক্রিয় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অপরদিকে বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক পানি প্রবাহের চেয়ে অনেক গুণ বেশি পানি ছেড়ে দেওয়ায় উত্তরবঙ্গের বিস্তর এলাকায় বন্যা কবলিত হয়ে ফসল, ঘরবাড়ি, গবাদিপশু ও পরিবেশ প্রকৃতির ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।
এ সময় বাংলাদেশ কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে তিস্তা সমাবেশ থেকে ৯টি দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হলো- কৃষক সমিতির সারা বছর তিস্তা নদীর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করো। ভারতের সঙ্গে দ্রুত পানি চুক্তি করে পানির হিস্যা আদায় করো। তিস্তা নদীকে মেরে ফেলার হাত থেকে রক্ষা করা। তিস্তাসহ অন্যান্য নদী, খাল, বিল, জলাশয় পরিকল্পিতভাবে খনন করে তলদেশের নাব্যতা বজায় রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। দেশপ্রেমিক নদী গবেষকদের পরামর্শের ভিত্তিতে তিস্তার পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। তিস্তা নদীর দুই পাড়ের মানুষের যাতায়াত ও কৃষিপণ্য দ্রুত হাট-বাজারে নেওয়ার জন্য সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন করো। নদী ভাঙন, কৃষকের ফসল, গবাদিপশু, ঘরবাড়ি রক্ষার জন্য পরিকল্পিত স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করো। নদী ভাঙনে (সিকস্তি) ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষতিপূরণ দাও। জেগে ওঠা জমি (পয়স্তি জমি) প্রকৃত মালিকদের ফিরিয়ে দাও। ভূমিহীন মানুষকে খাসজমি বরাদ্দ দাও। বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচের পানি বিতরণে ও গভীর নলকূপের অপারেটর নিয়োগে অনিয়ম-হয়রানি-দুর্নীতি বন্ধ করো। অপারেটরদের দৌরাত্ম্য রোধ করো।
সমাবেশ শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল রংপুর শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এতে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও ঠাকুরগাঁওয়ের সহস্রাধিক কৃষক অংশ নেন।
এর আগে শনিবার দুপুরে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে বাংলাদেশ কৃষক সমিতির পূর্বনির্ধারিত তিস্তা কৃষক সমাবেশ করতে দেয়নি পুলিশ। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে কৃষক সমিতি। আর পুলিশ জানিয়েছে, অনুমতি না থাকায় জনস্বার্থে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে রংপুর মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (কোতোয়ালি জোন) মো. আরিফুজ্জামান বলেন, এটা জনস্বার্থে করা হয়েছে। পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে লিটলম্যাগ মেলা ও কবিতা উৎসব চলছে। সেখানে শহীদ মিনারের পাশে পিঠা উৎসবও হচ্ছে। কৃষক সমিতি তাদের প্রোগ্রামের ব্যাপারে কোনো অনুমতি নেয়নি। আমরা এই প্রোগ্রাম সেখানে না করার ব্যাপারে তাদের আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম।
মোঃ আব্দুল কাদের/হক_কথা