সাহিত্য

জোর

  প্রতিনিধি ১২ মার্চ ২০২৪ , ১:২২:৪৭

শেয়ার করুন

ভাইয়া আগামী সপ্তাহে আমার দুই দিন ছুটি লাগবে।
কেন?
আমার শ্বশুরের বিয়ে।

আমি বিস্মিত হয়ে আমার কলিগের দিকে তাকালাম। গল্প উপন্যাসে এমন পড়ি। কিন্তু বাস্তবে খুব পরিচিত কারো শ্বশুর বিয়ে করবে শুনতে কেমন যেন লাগছে।

আপনার হাজব্যান্ড কি বাবার এই বিয়েতে খুশী?

জী খুশী। আমার শাশুড়ি মারা গিয়েছে অনেক বছর। উনার দুই ছেলে দেশের বাইরে থাকে। আমি ঢাকায় থাকি, অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকি। উনি কিশোরগঞ্জ থাকেন। খুব নিঃসঙ্গ একজন। দেখার কেউ নেই। কথা বলার একজন সঙ্গী নেই। আমিও হয়তো কিছুদিনের মধ্যে দেশের বাইরে আমার হাজব্যন্ডের কাছে চলে যাবো। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে এপ্লাই করেছি।

আমার মন তবুও খচখচ করছে। আহা মানুষের জীবন। উনার একসময় স্ত্রী ছিলেন। সেই স্ত্রী বেঁচে থাকলে কি তিনি খুশী হতেন? কিন্তু ছেলেরা মেনে নিয়েছে। বরং তারা বাবাকে উৎসাহ দিচ্ছে। এই সময়ে একজন সঙ্গীর বড় প্রয়োজন। ভালোবাসার প্রচলিত ধারনার বাইরেও প্রয়োজনের ব্যাপারটাকে অস্বীকার করা যায় না। মাঝে মধ্যে সেটাই মুখ্য হয়ে দাড়ায়।

আমি কালকে আমার বাবা, মা, নিতু এবং ছেলেকে নিয়ে কক্সবাজার যাচ্ছি। মনের মধ্যে একটা ফুরফুরে ভাব কাজ করছে। বৃহস্পতিবার আমার খুব প্রিয়। তার সঙ্গে রবি, সোম ছুটি নিয়েছি। এইবার সেন্টমার্টিনের প্ল্যানও কমপ্লিট। প্রবাল দ্বিপ ঘুরে আসবো।

হটাত চোখের সামনে আমার শ্বশুরের চেহারা ভেসে উঠলো। আমার শাশুড়ি মারা গিয়েছেন আমার বিয়েরও আগে। সেই হিসেব করলে আজ পনেরো বছর হবে। আমার শ্বশুর একাই জীবন কাটাচ্ছেন। একমাত্র ছেলে তাও আট বছর ধরে দেশের বাইরে। আমার বিয়ের বারো বছর। প্রথম দিকে প্রায় আমার শ্বশুর আমাদের বাসায় আসতেন। বলতেন

এই যে পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। হটাত মনে হলো মেয়েটাকে দেখে যাই।

আমরা প্রায় জোর করতাম। আজকে থেকে যান।

উনি বলতেন

না। না। কত কাজ আছে। আবার আসবো।

আমার চোখের সামনে কত স্মৃতি

একদিন আমি, নিতু শপিং-মলে গিয়েছি। আসতে আসতে বেশ রাত। বাসার সামনে নামতেই মোড়ের চা দোকানদারের ছেলেটা এসে বললো

আপনার শ্বশুর চায়ের দোকানে। দোকানের সঙ্গেই একটা শোয়ার জায়গা আছে সেখানে ঘুমিয়ে গিয়েছে।

নিতু ভীষণ রাগ করলো।

বাবা তুমি কেন চায়ের দোকানে ঘুমিয়েছো? বাসায় এসে বসতে। নীচতলার ভাবির কাছে একটা চাবি ছিলোতো।

সেদিন আমার বাবা, মাও গ্রামে গিয়েছিলো। বাসা খালিই ছিলো। আমার শ্বশুর মাথা নেড়ে বললো

নারে মা। এদিকে এসেছিলাম। দারোয়ানের কাছ থেকে শুনলাম তোরা কেউ নেই। ভাবলাম চায়ের দোকানে অপেক্ষা করি। কখন যে ঘুমিয়ে পরলাম। এতো সুন্দর সুন্দর পুরাতন দিনের গান হচ্ছিলো। তোর মায়ের কথা খুব মনে পরছিলো।

আমি নিতুকে রাতের বেলায় বললাম

তোমার বাবার মায়ের প্রতি সেই প্রেম।

সেদিনও উনি আমার বাসায় থাকেন নি। চলে গেলেন।

একদিন নিতুর ভীষণ জ্বর। সারারাত ছটফট করছে। কিছুই খেতে পারছে না। বমি করে দিচ্ছে। ভোরবেলায় দেখি আমার শ্বশুর এসে উপস্থিত। নিতুর মাথার কাছে বসে বলছে

মা-রে কেমন আছিস?

বাবা খুব খারাপ লাগছে। সারারাত একফোঁটাও ঘুমাতে পারেনি। কিছুই খেতে পারছি না, বমি হয়ে যাচ্ছে।

মা-রে আমিও যে সারারাত ঘুমাতে পারেনি। আমিও যে কিছুই খেতে পারছি না।

আজ আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই নিঃসঙ্গ মানুষটা তার সন্তানদের মধ্যে আনন্দ খুঁজে বেড়ান। সম্পর্কে জোয়ার ভাটার টান আসে। গত কয়েক বছরে উনার শরীর ভেঙেছে। এখন আর আগের মতো আসেন না। মেয়েকে ফোন দেন, খবর নেন, নাতির খবর নেন। কোন প্রোগ্রাম থাকলে, দাওয়াত দিলে আসেন। আগের থেকে অনেক চুপচাপ হয়ে গেছেন। একটা ছেলে থাকে সঙ্গে সে দেখাশুনা করে। নিতুর ভাইও বিদেশে গিয়েছে আজ প্রায় আট বছর। মাঝে কয়েকবার এসেছিলো। তাও প্রতিবার এক/দুই মাসের জন্য। নিতুও হয়তো সমাজের কারনে বাবাকে নিজের কাছে জোর করে রাখতে চেষ্টা করেনি। আমিও কখনো ওকে কিছু বলিনি।

আমার কলিগের এই কথা শুনার পর মনে হচ্ছে। আসলে আমরা যেটাকে খুব মহৎ একটা কাজ ধরে নিয়েছিলাম যে উনি আর বিয়ে করেননি। অথচ আমরাও কেউ উনাকে কখনো সময় দেইনি। উনাকে বলেছিলাম

বাবা আজকে আমাদের সঙ্গে থাকেন। তবে সেই বলাতে তেমন জোর ছিলো না। অথচ অফিসের বসকে বলার সময় যেন হৃৎপিণ্ড বের করে দেই। আপনাকে আসতেই হবে বস। আপনি না আসলে কিন্তু আমি খাবো না।

আমি প্রথমে খবর নিলাম আমার শশুর কোথায় আছেন। শুনলাম উনি বাসাতেই আছেন। এরপর ফোন দিলায় এয়ারলাইন্সে। না কোনভাবেই আগামীকালের একটা এক্সট্রা টিকেট ম্যানেজ করতে পারলাম না। পরে ফোন দিলাম বাস কাউন্টারে। রাত এগারোটায় কক্সবাজারের বাসের একটা টিকেট কাটলাম। হোটেলে ফোন দিলাম। সেখানেও একেই অবস্থা রুম নেই। তারপর ফোন দিলাম আমার বাবা, মা-কে। উনাদের বুঝিয়ে বললাম আমার অনুভূতির কথা। নিতুকে জানাতে মানা করলাম। অফিস থেকে বের হয়ে সোজা শ্বশুরের ফ্ল্যাটে চলে আসলাম।

কাজের ছেলেটা দরজা খুললো।

দুলাভাই।

কিরে বাবা কই?

উনি ঘুমাচ্ছে।

এই অবেলায় ঘুম।

বিকেলে একটু হাঁটতে বের হয়েছিলো। তারপর বাসায় এসে কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পরেছেন। কিন্তু একটু পরেই জেগে উঠবেন। আর সারারাত ঘুমাবেন না।

শুন তুই তাড়াতাড়ি লাগেজে উনার জামা, কাপড়, ওষুধ সব গুছিয়ে দে।

আমি শ্বশুরের বিছানায় গিয়ে ডাক দিলাম

বাবা ঘুমিয়েছেন?

দেখি উনার চোখ খোলা

আরে তুমি? কখন আসলে?

বাবা আপনাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।

কোথায়?

কাল আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি, আপনি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন।

হুম সেটাতো জানি তোমরা যাচ্ছ। তুমি বলেছো তাতেই আমি খুশী। দোয়া রইলো বেটা।

বাবা আজকে আপনার কোন কথা শুনবো না। আমি আমার জন্য রাতে বাসের টিকেট কেটেছি। আর এয়ারলাইন্সে আমার জায়গায় আপনি যাচ্ছেন তা ইতিমধ্যে বলে দিয়েছি। হোটেল, রুম সব ঠিক।

আরে আমি বেশিক্ষণ হাটতেঁ পারি না। বাদ দাও আমাকে।

আজকে কোনভাবেই আমি আপনাকে বাদ দিবো না। দরকার হলে আপনাকে কোলে করে তুলে নিয়ে যাবো।

আমার একরোখা জোরাজোরিতে অবশেষে আমার শ্বশুর যাচ্ছেন।

পরেরদিনের পরের দিন।

সমুদ্র সৈকতে আমরা দুইটা ছাতা-ওয়ালা সিট নিয়েছি। আমি আমার বাবা, মায়ের সঙ্গে বসে ডাব খাচ্ছি। সামনে অসীম সমুদ্র। কি দারুণ সমুদ্রের গর্জন। আমরা হোটেলে অতিরিক্ত রুম পাইনি। একরুমে আমি, বাবা এবং আমার শ্বশুর থাকি আরেক রুমে আমার বউ, আমার মা এবং আমার ছেলে থাকে।

আমার বউ তার বাবাকে ডাবের পানি খাওয়াচ্ছে।

আমার বাবা আমাকে বলছেন

আজকে তোর উপর অনেক গর্ব হচ্ছেরে বেটা।

কেন আব্বা?

দেখ আমার বউমা এই ট্যুরে কি খুশি। কি আনন্দিত। আমি কিছুক্ষণ পরপর তার চোখে অশ্রুর ঝিলিক দেখতে পাচ্ছি। আমার বেয়াই কত নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। তুই যে উনাকে নিয়ে আসতে পেরেছিস, উনার অনুভূতিটা উপলব্ধি করেছিস বাবা হিসেবে তাই তোকে নিয়ে আজকে আমার খুব গর্ব হচ্ছে বেটা। ইচ্ছে করছে তোকে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। আমার বউমাকে খুব বকা দিতে ইচ্ছে করছে। কেন সে তার বাবাকে নিজের কাছে রাখছে না। কি অসুবিধে?

আমরা তিনজন তখন একজন মেয়ে এবং তার পিতার সমুদ্রের পাশে অসম্ভব সুন্দর মায়ার সম্পর্ক দেখছি। তাদের ভালোবাসার সম্পর্ককে অনুভব করছি।

আহা কি অপূর্ব এই মায়া, এই ভালোবাসা।।

—– সমাপ্ত —–

জোর
আমিনুল


শেয়ার করুন

আরও খবর

Sponsered content