প্রতিনিধি ১৪ মার্চ ২০২৪ , ১২:৫৩:৪৪
রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজানুল মোবারকের আজ তৃতীয় দিন। রমজান মাসে প্রতিদিন সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও কামাচার বর্জনের মাধ্যমে সিয়াম পালন করা হয়। এটিই এ মাসের প্রধান ও প্রথম পালনীয়। তবে সিয়াম পালনের পাশাপাশি আরেকটি ইবাদত অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে এ মাসের সঙ্গে। অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে মুমিন বান্দারা এতে মশগুল থাকেন। পবিত্র রমজানের সঙ্গে এটির ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক। সালাতুত তারাবি নামে পরিচিত ইবাদতটির কারণে পবিত্র মাসের গাম্ভীর্য ও প্রেম বেড়ে যায় অনেক গুণ। আল্লাহর প্রিয় বান্দারা দিনে রোজা রেখে ও রাতে এশার সালাতের পর দীর্ঘ তারাবির নামাজের কষ্ট আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করেন। সারা দিনের ক্লান্তি উপেক্ষা করে দীর্ঘ সময়ের এই সালাতে নিমগ্ন থাকা আল্লাহ তায়ালার প্রতি একান্ত আত্মনিবেদন ও তাঁর পাক কালামের প্রতি তাদের উৎসাহ ও অনুরাগের প্রমাণ। তা ছাড়া প্রতিদিন এশার নামাজের পর মসজিদে যখন আল্লাহর পবিত্র বাণীর তেলাওয়াত চলতে থাকে, তখন পুরো দেশজুড়ে বিরাজ করে অনুপম আবহ। কোরআন মাজিদের তেলাওয়াতে বেহেশতি সুর মূর্ছনায় মুগ্ধ হন মুসল্লিরা। জামাতের সঙ্গে সালাতুত তারাবির বর্তমান নিয়মটি চালু হয়েছে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর সময় থেকে। এর আগে অর্থাৎ রাসুলে পাক (সা.) ও হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর সময়ে এমনকি হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর খেলাফতকালের প্রথম ভাগেও মুসলমানরা রমজানের রাতগুলোয় এশার নামাজের পর অতিরিক্ত যে সালাত আদায় করতেন, তা একাকী করতেন। এ জন্য জামাত বা সম্মিলিত কিছুর আয়োজন ছিল না। তবে নবী করিম (সা.) রমজানে কিয়ামুল লাইল বা রাত জেগে ইবাদত-বন্দিগির বিশেষ উৎসাহ দিয়েছেন এবং এ জন্য অশেষ পুরস্কারের সুসংবাদ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণিত একটি হাদিস উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) রমজানের রাতগুলোয় ইবাদত করার জন্য আমাদের উৎসাহ দিতেন। কিন্তু জোরালো আদেশ দিতেন না। তিনি বলতেন, যে ব্যক্তি রমজানে ঈমান ও ইহতিসাবের সঙ্গে কিয়াম করবে, তার ইতঃপূর্বেকার সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। এভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে রাতের ইবাদত করার নিয়ম চালু ছিল তার জীবদ্দশায়। হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর সময়ে একই নিয়ম চালু ছিল। এটিই বহাল ছিল হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর খেলাফতকালের প্রথম ভাগেও। (বুখারি শরিফ) হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর সময়ে জামাতের সঙ্গে সালাতুত তারাবি চালু হওয়া সম্পর্কে একটি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন আবদুর রহমান ইবনে সায়েব ইবনে আবদুল কারি নামে এক তাবেয়ি। তিনি বলেন, রমজানের এক রাতে হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর সঙ্গে আমি মসজিদে নববিতে গেলাম। দেখলাম লোকরা বিক্ষিপ্তভাবে ইবাদত করছে। কেউ একাকী, আবার কারও সঙ্গে কয়েকজন যোগ দিয়ে নফল নামাজ আদায় করছেন। হজরত ওমর (রা.) বললেন, এদের সবাইকে একজন তেলাওয়াতকারীর পেছনে একত্র করে দিলে ভালো হতো। পরে হজরত উবাই ইবনে কাবকে ইমাম নিযুক্ত করা হয়। কেননা হজরত উবাই (রা.) ছিলেন সাহাবিদের মধ্যে সবচেয়ে শুদ্ধ ও মধুর কণ্ঠে কোরআন মাজিদ তেলাওয়াতকারী। এরপর এক দিন আবারও বের হলেন হজরত ওমর (রা.)। বর্ণনাকারী আবদুর রহমান বলেন, হজরত উবাই (রা.)-এর ইমামতিতে তখন এই নামাজ চলছে। পরিবেশটি দেখে হজরত ওমর মুগ্ধ হলেন এবং বললেন, চমৎকার আবিষ্কার এটি। তবে তিনি একই সঙ্গে একটি মন্তব্যও করলেন। বললেন, তোমাদের ঘুমের সময়টা তোমাদের জেগে থাকার সময় থেকে ভালো অর্থাৎ হজরত ওমর (রা.)-এর ব্যক্তিগত পছন্দ ছিল লোকরা প্রথম রাতে এশার নামাজের পরই ঘুমিয়ে পড়ুক আর মধ্য রাতের পর ইবাদতে মশগুল হোক। কিন্তু তা সাধারণভাবে কষ্টের কাজ। লোকরা এমনটি অভ্যাস করতে পারবে বলে তিনি মনে করলেন না। বিশেষ করে সাহাবায়ে কেরামের যুগেই যখন ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটছিল, তখন নতুন মুসলমানদের পক্ষে এমন কষ্ট সহ্য করা সহজ হবে না বলে মনে করলেন ইসলামের খলিফা। তা ছাড়া একাকী দীর্ঘক্ষণ সালাত আদায় করার চেয়ে জামাতের সঙ্গে আদায় করা কম কষ্টকর। তেমনি কোরআন মাজিদের বড় বড় সুরা সবার মুখস্থ থাকে না। এসব দিক বিবেচনা করে সবার জন্য যা সহজ হয় তারই ব্যবস্থা করলেন তিনি। ২০ রাকাত নামাজ আদায় করতে গিয়ে প্রতি চার রাকাতের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার রীতি ছিল। কেননা এই সালাত আদায় করা হয় দীর্ঘ সময় ধরে। আরবি তারবিহা অর্থ বিশ্রাম। আর তারবিহা শব্দের বহুবচন তারাবি। তারাবি নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায়ের কারণে রোজাদার মুসলমানদের মধ্যে গড়ে উঠতে পারে ঐক্য ও সম্প্রীতির দৃঢ় বন্ধন। এ জন্য হজরত ওমর (রা.)-এর সময় থেকে এ পর্যন্ত সারা বিশে^ মুসলমানদের মধ্যে রমজানুল মুবারকে সিয়াম সাধনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে গেছে তারাবি সালাতের জামাত। শহর এলাকার বেশিরভাগ মসজিদে খতম তারাবি হয়ে থাকে। ফলে যারা নিয়মিত তারাবি নামাজে অংশ নেন, তাদের পক্ষে পুরো কোরআন মাজিদ একবার শোনার সুযোগ হয়। অতএব বিশেষ কোনো অসুবিধা না থাকলে রমজান মাসে সিয়াম পালনের পাশাপাশি সালাতুত তারাবিতে নিয়মিত যোগদানে সচেষ্ট থাকা উচিত।
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি
মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী