অন-লাইন

বিমান দ্রুত চলে কিন্তু আকাশে বিমান দেখতে ধীর মনে হয় কেন

  প্রতিনিধি ২১ মার্চ ২০২৪ , ২:৩৩:০২

শেয়ার করুন

যাত্রীবাহী জেট বিমান সাধারণত ছোটে ঘন্টায় ৫৭৫ মাইল বেগে। গাড়ির স্বাভাবিক গতির চেয়ে প্রায় নয় গুণ বেশি। মজার ব্যাপার হলো, নিচ থেকে দেখে বিমানের এই গতিবেগ বোঝা যায় না। মনে হয় বেশ ধীরে যাচ্ছে। কেন এমন হয়?

উড়োযানের সবকিছু পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র মেনে তৈরি। তাই পদার্থবিজ্ঞানের সাহায্যেই এর ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। আসলে শুধু নিচ থেকে নয়, বিমানের যাত্রীরাও বিমানের গতির বিষয়টা খুব একটা বুঝতে পারেন না। কারণ, যেকোনো বস্তুর গতিবেগ বোঝার জন্য প্রসঙ্গ কাঠামো বা প্রসঙ্গ বিন্দু খুব জরুরি। কোনো বস্তু এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে গেলে বস্তুটির সরণ হয়। সময়ের সঙ্গে বস্তু কোনদিকে কী পরিমাণ সরছে, তা-ই বস্তুটির গতিবেগ। বস্তু আদৌ সরছে কি না, তা বোঝার জন্য যাত্রা শুরুর বিন্দু সম্পর্কে জানা জরুরি। শুরুর বিন্দু থেকে বস্তু কোনদিকে গেছে, তা জানলে বস্তুটির কী পরিমাণ সরণ হয়েছে, তা বের করা যায়।

কিন্তু গতিবেগ বের করতে হলে এটুকু যথেষ্ট নয়। শুরুর বিন্দু থেকে শেষ বিন্দুতে যেতে ওই বস্তুর কী পরিমাণ সময় লেগেছে, তাও জানতে হবে। এতে জানা যায় বস্তুর গড় বেগ। কিন্তু তাৎক্ষণিক বা নির্দিষ্ট কোনো মুহূর্তের গতিবেগ জানার জন্য প্রয়োজন আরও নিরপেক্ষ বিন্দু। এই বিন্দুকে বলা হয় প্রসঙ্গ বিন্দু।

 

  • বিমান যখন উড়তে শুরু করে বা নেমে আসে, তখন মাটি ও আশপাশের স্থাপনার কারণে সহজেই আমরা প্রসঙ্গ বিন্দু পাই। তখন বিমানের গতিটাও ভালোভাবে বোঝা যায়।

 

প্রসঙ্গ বিন্দু স্থির হতে হয়। নাহয় বস্তুর গতিবেগ সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় না। কিন্তু আমরা জানি, মহাবিশ্বের কোনো বস্তুই আসলে পুরোপুরি স্থির নয়। সবকিছু ঘুরছে, ছুটছে প্রতিমুহূর্তে। তাই প্রসঙ্গ বিন্দু আপেক্ষিকভাবে স্থির হলে একে স্থির বিন্দু ধরা হয়। আপেক্ষিকভাবে স্থির হওয়ার অর্থ হলো, অন্য আরেকটি বিন্দুর সাপেক্ষে প্রসঙ্গ বিন্দুকে স্থির হতে হবে। আসলে দুটি বস্তু একই বেগে চললে একটার সাপেক্ষে অন্যটাকে স্থির ধরা হয়।

একটু জটিল হয়ে গেল কী? চলুন, সহজে বোঝার জন্য একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। রাস্তার পাশে দাঁড়ালে আমরা হুশ করে যানবাহন ছুটে যেতে দেখি। গতিবেগ বুঝতে পারি। কারণ, গাড়ি রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে। কিন্তু এই রাস্তা, আশপাশের ভবন বা গাছপালা—সবই স্থির। এগুলোর যেকোনোটা প্রসঙ্গ বিন্দু ধরতে পারেন। এমনকি আপনি নিজেও একটি প্রসঙ্গ বিন্দু। কারণ, স্থির দাঁড়িয়ে আছেন। (আসলে কিন্তু আপনি স্থির না। কারণ, পৃথিবী গতিশীল। পৃথিবীর ওপর দাঁড়িয়ে থাকার কারণে আপনিও গতিশীল। কিন্তু সমগতিতে থাকায় আপনি পৃথিবীর সাপেক্ষে স্থির)। আপনার সাপেক্ষে গাড়িটি একটি নির্দিষ্ট বেগ নিয়ে ছুটে যাচ্ছে। গাড়ির সঠিক গতিবেগ বোঝার জন্য আপনার স্থির থাকা জরুরি। এখন আপনি যদি আরেকটি গাড়িতে চড়ে সমান বেগে ওই গাড়ির পাশাপাশি একই দিকে ছোটেন, তাহলে গাড়িটাকে আপনার কাছে গতিশীল বলে মনে হবে না। কারণ, আপনিও তখন গতিশীল। কিন্তু আপনারা দুজনে দুজনের সাপেক্ষে স্থির। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কেউ যদি আপনাদের দেখে, তাহলে তিনি আপনাদের দুজনকেই গতিশীল দেখবেন। কারণ, তিনি নিজে স্থির। আসল কথা হলো, অন্য কোনো প্রসঙ্গ বিন্দুর (অর্থাৎ, স্থির বিন্দু বা কোনোকিছুর) দিকে না তাকালে বুঝতেই পারবেন না, আপনি গতিশীল।

বিমান যখন উড়তে শুরু করে বা নেমে আসে, তখন মাটি ও আশপাশের স্থাপনার কারণে সহজেই আমরা প্রসঙ্গ বিন্দু পাই। তখন বিমানের গতিটাও ভালোভাবে বোঝা যায়। কিন্তু যখন আকাশে উঠে পড়ে, তখন বিমানের পেছনে থাকে সীমাহীন নীল আকাশ আর কিছু মেঘ। ভূপৃষ্ঠের মতো সহজ কোনো প্রসঙ্গ বিন্দু থাকে না। তাই পুরোপুরি বোঝা যায় না বিমানের বেগ। বিমানকে অনেক ধীর মনে হয়। অবশ্য এটাই একমাত্র কারণ নয়।

 

  • বিমানে আপনি কত বেগে যাচ্ছেন, তা জানার বেশ কিছু উপায় আছে। অনেক সময় বিমান মাটির কাছাকাছি থাকলে মাটিতে বিমানের ছায়া পড়ে।
    অনেক সময় বিমান মাটির কাছাকাছি থাকলে মাটিতে বিমানের ছায়া পড়ে।

ওপরের দিকে তাকালে আমাদের দৃষ্টিসীমাও অনেক বেড়ে যায়। বিমান থাকে অনেক দূরে। ফলে দৃষ্টিসীমা পার করতে বেশি পথ পাড়ি দিতে হয় বিমানকে। তাই গতি সম্পর্কে একধরনের বিভ্রম তৈরি হয় চোখে। এতে গতিবেগ কম মনে হয়। তা ছাড়া বিমান আমাদের থেকে অনেক দূরে থাকে। সে জন্য দূরত্বের কারণেও মনে হয় গতি কম।

শুধু বাইরের পর্যবেক্ষকের কাছেই যে বিমানকে ধীর মনে হয়, তা নয়। বিমানে থাকা যাত্রীর কাছেও এমনটা মনে হয়। কারণ ওই একই। এখানেও তেমন কোনো প্রসঙ্গ বিন্দু বা রেফারেন্স পয়েন্ট থাকে না। যাত্রী ও প্লেন একই বেগে গতিশীল। ওপর থেকে ভূপৃষ্ঠের কোনোকিছু প্রসঙ্গ বিন্দু হিসেবে ধরা খুব কঠিন। ফলে গতিবেগ নিয়ে তৈরি হয় ভ্রান্তি। একই কারণে ফাঁকা মাঠের মধ্য দিয়ে গাড়ি ছোটার সময় গতি ঠিক টের পাওয়া যায় না। কিন্তু শহরে বা গাছপালায় ঘেরা রাস্তায় অল্প গতিও খুব ভালোভাবে বোঝা যায়।

তবে বিমানে আপনি কত বেগে যাচ্ছেন, তা জানার বেশ কিছু উপায় আছে। অনেক সময় বিমান মাটির কাছাকাছি থাকলে মাটিতে বিমানের ছায়া পড়ে। তা ছাড়া বিমান উড্ডয়নের সময় ছায়া বাড়তে থাকে। নামার সময় উল্টো ঘটনা ঘটে, ছোট হতে থাকে ছায়া। এ ছায়া আপনার নজরেও আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে খেয়াল করলে দেখবেন, বিমানের ছায়া কত দ্রুত মাঠ, বিল্ডিং পেরিয়ে যাচ্ছে। এই ছায়া দেখে মাটির সাপেক্ষে বিমানের বেগ বোঝা যায়। একইভাবে বিমান বা হেলিকপ্টার তুলনামূলক নিচ দিয়ে উড়লে বাইরে থেকে দেখে গতিবেগ বোঝা যায়।

বিমানের ভেতর থেকে গতিবেগ বোঝা কঠিন হলেও মাপা কঠিন নয়। ফোনের জিপিএস ব্যবহার করে যেকোনো সময় বিমানের বেগ মাপা যায়। জিপিএস হলো গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমের সংক্ষিপ্ত রূপ। কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে পৃথিবীতে আপনার অবস্থানের পরিবর্তন হিসেব করে গতিবেগ জানিয়ে দিতে পারে এটি। জিপিএসের সাহায্যে বেগ মাপার জন্য ফোনে বিভিন্ন অ্যাপ আছে। ফোন এয়ারপ্লেন মোডে থাকলেও জিপিএস ব্যবহার করা যায়।

প্রদায়ক, বিজ্ঞানচিন্তা

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: দ্য কনভারসেশন, উইকিপিডিয়া


শেয়ার করুন