সারাদেশ

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় বছরে ৫শ’ কোটি টাকা চাঁদাবাজি

  প্রতিনিধি ৭ অক্টোবর ২০২৪ , ১:৫৬:৩১

শেয়ার করুন

পার্বত্য তিন জেলায় বছরে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি হয় প্রায় সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা। পরিবহন, দোকান, বাজার স্থাপনা থেকে এসব চাঁদা তোলে কয়েকটি আঞ্চলিক সংগঠন। এছাড়া অবৈধ অস্ত্রের মাধ্যমে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় দ্বন্দ্বে জড়ায় তারা। এতে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে পাহাড়; আতঙ্ক-উদ্বেগ বাড়ে জনমনে।

পাহাড়ের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের পথে বড় কোনো গাড়ির দেখা না মিললেও স্থানীয় অধিবাসীদের চলাচলে ব্যাটারি চালিত রিকশার দেখা যায়। কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রত্যেকটি ব্যাটারি চালিত গাড়িকে বছরে চাঁদা দিতে হয় ১ হাজার টাকা করে। আঞ্চলিক সংগঠনের নামে তোলা এই চাঁদার টোকেন দেখিয়েই করতে হয় চলাচল।

এরপর যাওয়া হয় খাগড়াছড়ি এলাকার স্বনির্ভর বাজারে। এখানেও চাঁদা দিতে হয় পাহাড়ী-বাঙালি উভয়কে। কিন্তু চাঁদা নিয়ে কথা বলতে রাজি নয় কেউ। এমনকি স্বনির্ভর বাজার থেকে পানছড়ি যেতেও চাঁদা দিতে হয় শত শত যানবাহনকে। শহর-জুড়ে চাঁদার এ ঘটনা যেন স্বাভাবিক।

বিষয়গুলো অজানা নয় স্থানীয় প্রশাসনের। কিন্তু কথা বলতে নারাজ তারা। চাঁদার বিষয়ে অকপট স্বীকারোক্তি দিলেন আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফর মুখপাত্র অংগ্য মারমা। সংগঠন পরিচালনার জন্যই নাকি তোলা হয় এই বিপুল অংকের চাঁদা।

অংগ্য মারমা বলেন, একটি সংগঠন পরিচালনা করতে গেলে কিছু ফান্ড দরকার হয়। সেটা সদস্যদের মাধ্যমে হতে পারে বা শুভাকাঙ্ক্ষীদের মাধ্যমে হতে পারে। চাঁদার ব্যাপারে কোনো রাখ ঢাক ছাড়াই বললেন, প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ থেকে তোলা হয় চাঁদা। শুধু তাই না সশস্ত্র গোষ্ঠিগুলোর পক্ষে দিলেন সাফাই। তিনি বলেন, মানুষ যখন বহুদিন ধরে নিপীড়িত হয় তখন তারা সশস্ত্র হয়ে যায়।

এই বিপুল চাঁদাবাজির বলি হচ্ছে পার্বত্য তিন জেলার প্রায় ১৮ লাখ মানুষ। প্রভাব পড়ে স্থানীয় অধিবাসীদের দৈনন্দিন অর্থনীতিতে।

সরকারি সংস্থায় প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপর থেকে চুক্তি মোতাবেক কাজগুলো পর্যায়ক্রমে সম্পন্ন হচ্ছে। এরপরও আঞ্চলিক সংগঠনের সশস্ত্র কর্মীরা তিন পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও চাঁদাবাজি অব্যাহত রেখেছেন। এমনকি স্থানীয় সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে জাতীয় রাজনৈতিক দলের ৩৫৫ জন উপজাতীয় নেতাকর্মী দল থেকে (আওয়ামী লীগ) পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। বর্তমানে সেখানে বিরোধী নেতাকর্মীরা নিষ্ক্রিয় রয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজাতীয় আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন কর্তৃক সাধারণ নাগরিকসহ বিভিন্ন খাত থেকে চাঁদা আদায় করছে। এরমধ্যে যানবাহন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মালিকানাধীন বিভিন্ন বাগান, বেসামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী, ঠিকাদারসহ নানা পেশার মানুষ থেকে বছরে প্রায় ৩শ’ থেকে ৪শ’ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করছে। যা তাদের অস্ত্রের ভান্ডার সমৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে ব্যয় করে থাকে।

 

গত ৩ বছরে চাঁদাবাজির এক পরিসংখ্যা থেকে জানা গেছে, খাগড়াছড়ি জেলা থেকে ২০১৭ সালে ১৩২,৯৩,৯৭,৯২৮ টাকা। ২০১৮ সালে ১৩৯,২৬,২৪,৫০০ টাকা, ২০১৯ সালে ১৩৭,৫৩,৮৮১০০ টাকা।

রাঙ্গামাটি জেলা থেকে ২০১৭ সালে ১২০,৭৫,৩৬,৮০০ টাকা। ২০১৮ সালে ১২৮,৪৯০৭৮০০। ২০১৯ সালে ১১৯,৪৬,৪৫৯০০ টাকা।

বান্দরবন জেলা ১১৩,৫৩,৪৭,৩০০ টাকা। ২০১৮ সালে ১২১,৪৬,৩০,০০০। ২০১৯ সালে ১১৭,২৮,৮২,০০০ টাকা।

হিসাব থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০১৭ সালে ৩ পার্বত জেলায় চাঁদাবাজি হয়েছে ৩৬৭,২২,৮২,০২৮ টাকা। ২০১৮ সালে ৩৮৯,২১,৬২,৩০০ টাকা। ২০১৯ সালে মোট ৩৭৪,২৯,১৮,০১৯ টাকা চাঁদাবাজি হয়েছে। সব মিলিয়ে চাঁদাবাজির টাকার পরিমাণ হচ্ছে ১ হাজার ১৩০ কোটি, ৭৩ লাখ ৬২ হাজার ৩৪৭ টাকা।

জানা গেছে, পার্বত্য অঞ্চলে আঞ্চলিক দলগুলো নিজেদের আধিপত্য বিস্তার ও এবং চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে হত্যা, অপহরণ, গোলাগুলি, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুরসহ নানাভাবে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে লিপ্ত আছে। আঞ্চলিক দলগুলো বর্তমানে অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করছে। তার মধ্যে এমজি, এলএমজি, এসএমজি, রাইফেল, পিস্তল, গ্রেনেড এবং বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক উল্লেখযোগ্য। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের গত অক্টোবর পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যমতে, সংঘাতে ৯৭ জন নিহত, ৩৫টি অপহরণ, ১২টি গোলাগুলির ঘটনাসহ মোট ৩শটি ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ অস্ত্র উদ্ধার সংক্রান্ত তথ্যে জানা গেছে, গত ২৯ নভেম্বর রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি এলাকা থেকে ২টি একে-৪৭ রাইফেলসহ গুলি ও ম্যাগজিন উদ্ধার করেছে সশস্ত্র বাহিনী।

প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, স্থানীয় আঞ্চলিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ৮০ জন উপজাতি নিজ এলাকায় অবস্থান করলেও নিজ পরিবারের সদস্যদের আতঙ্কে পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে সুদূরপ্রসারী অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। যা ভবিষতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক বিষয়ে তার প্রভাব পড়তে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।

গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তিন পার্বত্য জেলার অপরাধ প্রবণতা নিয়ে একটি পরিসংখ্যা তৈরি করেছেন। ওই পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০১৪ সাল থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলে সংঘাতে মারা গেছে ৩৭৬ জন। এরমধ্যে উপজাতি মারা গেছেন ২৫৬ জন। বাঙালি মৃত্যুবরণ করেছেন ১২০ জন। আর উপজাতি ও বাঙালি সংঘাতে আহত হয়েছে ৯৭৪ জন। এরমধ্যে উপজাতি ৩০১ জন। বাঙালি ৬৭৩ জন। অপহরণের ঘটনার মধ্যে উপজাতি ৩৬৯ জন, বাঙালি ১৬৯ জন। বন্দুকযুদ্ধ বা গোলাগুলির ঘটনা ২১৭টি। গোলাবারুদ উদ্ধার ৬২২টি। গুলি উদ্ধার ১ হাজারেরও বেশি। উপজাতি সন্ত্রাসী গ্রেফতার ১৫৯৬ জন।

প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, আঞ্চলিক দলগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নানাভাবে হত্যাসহ নাশকতামূলক কর্মকান্ড চালাচ্ছে। এ নিয়ে এলাকার জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো সর্বশেষ গত ১৩ অক্টোবর বিকেলে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর এলাকায় সশস্ত্র বাহিনীর টহলের ওপর অতর্কিত গুলি চালায়। এ ঘটনায় একজন সেনা সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়। আর পাল্টা গুলিতে ২ সন্ত্রাসীর মৃত্যু হয়েছে। এসখান থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্র গোলাবারুদ্ধ উদ্ধার করা হয়েছে বলে আন্তঃবাহিনীর জনসংযোগ শাখা থেকে জানা গেছে।

জানা গেছে,২০১৯ সালের ১৮ মার্চ বাঘাইছড়ি উপজেলার নয় মাইল এলাকায় উপজেলা নির্বাচনী কর্মকর্তাদের উপর সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় ৮জন নিহত ও ১৮জন আহত হয়েছে। ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ বিলাইছড়ি উপজেলার সন্ত্রাসী হামলায় স্থানীয় ওঅর্ড যুবলীগ নেতার মৃত্যু হয়েছে। গুলিতে তিনি ঘটনাস্থলে মারা যান। তার নাম ক্য হ্রা চিং মারমা। ২০১৯ সালের ১৯ মে বান্দরবান জেলার পৌর আওয়ামীলীগের একজন নেতাকে নিজ বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে ওই বছরের ২৫ মে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। গত ২২ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানে সশস্ত্রী হামলায় স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামীলীগ নেতা বাচানু মারমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এ ভাবে প্রায় সময় রাঙ্গামাটি ও বান্দরবন ও খাগড়াছড়ি এলাকায় সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যার ঘটনা ঘটছে।

সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে উস্কানিমূলক পোস্ট দেয়াসহ শান্তি বিনষ্ট করার তৎপরতা চালাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এর পরও পুলিশসহ সশস্ত্রবাহিনী নানাভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিন পার্বত্য জেলার শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। তারা চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে ১৬শ’ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে আইনি প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নিয়েছেন।


শেয়ার করুন

আরও খবর

Sponsered content