প্রতিনিধি ১ অক্টোবর ২০২৫ , ৬:৩৩:৩৯

বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাত গত দুই দশকে বিরাট পরিবর্তনের সাক্ষী। সিম কার্ড একসময় ছিল বিলাসিতা, আজ তা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ। বর্তমানে প্রায় ১৮ কোটি মোবাইল সংযোগ সক্রিয়—কিন্তু তবুও গ্রাহকদের অভিযোগ, সেবা খরচ বেশি, প্যাকেজ সীমিত, আর প্রতিযোগিতা আসলে কাগজেই সীমাবদ্ধ।
ঠিক এই সময়েই রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেড (BTCL) ঘোষণা দিয়েছে—তারা চালু করতে যাচ্ছে MVNO (Mobile Virtual Network Operator) সিম। এই সিম দিয়ে গ্রাহকরা আগের চেয়ে কম দামে বেশি সুবিধা পেতে পারেন।
MVNO: সহজভাবে বুঝুন
MVNO মানে হলো এমন মোবাইল অপারেটর, যারা নিজে কোনো টাওয়ার বা নেটওয়ার্ক বসায় না। বরং দেশের বিদ্যমান অপারেটরদের (গ্রামীণফোন, রবি, এয়ারটেল, বাংলালিংক) নেটওয়ার্ক ভাড়া নেয়। ফলে অবকাঠামোগত খরচ কমে যায়, আর গ্রাহকরা পান সাশ্রয়ী দামে সেবা।
টেলিকম বিশ্লেষক মো. আশরাফ হোসেন বলেন,MVNO হলো এক ধরনের শেয়ার ইকোনমি মডেল। যেমন উবার গাড়ি কিনে না, বরং চালকের গাড়ি ব্যবহার করে; ঠিক তেমনি BTCL সরাসরি নেটওয়ার্ক বসাবে না, ভাড়া নেবে বিদ্যমান অপারেটরের। ফলে খরচ বাঁচবে, প্রতিযোগিতা বাড়বে।
গ্রাহকের জন্য সম্ভাব্য সুবিধা
1. সাশ্রয়ী প্যাকেজ – কম দামে কল ও ডেটা প্যাক।
2. আলাদা প্ল্যান – কেবল ভয়েস, কেবল ডেটা বা কম্বিনেশন—সব থাকবে।
3. আনলিমিটেড সুবিধা – শর্তসাপেক্ষে আনলিমিটেড কল ও ডেটা সুবিধা।
4. OTT কনটেন্ট – ইউটিউব, ফেসবুক ছাড়াও বঙ্গো, চোরকি, হইচই ফ্রি বা ডিসকাউন্টে পাওয়া যেতে পারে।
5. স্মার্টফোন কিস্তি – মাসে ৫০০ টাকায় কিস্তিতে স্মার্টফোন কেনার সুযোগ।
রাজধানীর এক তরুণ ব্যবহারকারী বলেন,
“এখন এক জিবি ডেটা কিনতে গিয়ে ৩০-৪০ টাকা চলে যায়। যদি BTCL কম দামে আনলিমিটেড অফার দেয়, তাহলে আমরা অবশ্যই নতুন সিম ব্যবহার করব।”
কেন এখন দরকার MVNO?
বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ বাজার মূলত তিনটি বড় কোম্পানি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাদের প্রায় একরকম প্যাকেজ ও মূল্যনীতির কারণে গ্রাহকের হাতে বিকল্প কম।
পোস্ট ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান,“গ্রাহকদের স্বার্থে নতুন প্রতিযোগিতা তৈরি করা সরকারের লক্ষ্য। MVNO চালু হলে বাজারে বৈচিত্র্য আসবে এবং ব্যবহারকারীরা আরও ভোক্তাবান্ধব প্যাকেজ পাবেন।”
চ্যালেঞ্জের মুখে BTCL
তবে প্রশ্ন থেকে যায়—BTCL কতটা সফলভাবে এটি বাস্তবায়ন করতে পারবে?
চুক্তির জটিলতা – বিদ্যমান অপারেটররা কত দামে নেটওয়ার্ক ভাড়া দেবে, সেটি নির্ধারণ কঠিন।
সেবার মান – অতীতে BTCL-এর ধীরগতির ইন্টারনেট ও দুর্বল কাস্টমার কেয়ারের অভিযোগ রয়েছে।
আর্থিক সংকট – টেলিটক ও BTCL-এর হাজার কোটি টাকার বকেয়া এখনো মেটানো হয়নি।
গ্রাহকের আস্থা – নতুন সিম চালু হলেও মানুষ কত দ্রুত তা ব্যবহার শুরু করবে, সেটিই বড় প্রশ্ন।
টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ মুনিরুজ্জামান খান বলেন,
“MVNO একটি ভালো উদ্যোগ। তবে কেবল ঘোষণায় কাজ হবে না। সেবা মান, গ্রাহক সাপোর্ট ও মূল্যনীতি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে না পারলে এটি ব্যর্থ প্রকল্প হয়ে যাবে।”
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
যদি পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়—
সস্তায় ইন্টারনেট পাবে গ্রাহক।
OTT প্ল্যাটফর্মকে ঘিরে নতুন ডিজিটাল ইকোসিস্টেম গড়ে উঠবে।
স্মার্টফোন কিস্তি স্কিম ডিজিটাল বিভাজন কমাবে।
বাজারে নতুন প্রতিযোগিতা তৈরি হবে, যা গ্রাহকদের পক্ষে যাবে।
BTCL-এর MVNO সিম চালুর উদ্যোগ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতে নতুন আলোড়ন তুলেছে। তবে পথ সহজ নয়। সফলতার জন্য দরকার শক্ত পরিকল্পনা, স্বচ্ছ চুক্তি, আধুনিক গ্রাহকসেবা এবং সাশ্রয়ী মূল্যের নিশ্চয়তা।
গ্রাহকের দিক থেকে প্রত্যাশা একটাই—কম দামে ভালো সেবা। BTCL যদি সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে, তবে এটি বাংলাদেশের মোবাইল বাজারে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।

















