প্রতিনিধি ৯ আগস্ট ২০২৩ , ১০:১৭:৫৭
বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম নগরে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা অনেকটা কেটে গেছে। উত্তর চট্টগ্রামেও পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হয়েছে। তবে দক্ষিণ চট্টগ্রামের কয়েকটি উপজেলা এখনো পানির নিচে। এর মধ্যে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও চন্দনাইশের অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। সেসব এলাকায় বিশুদ্ধ পানি আর শুকনো খাবারের জন্য অনেকটা হাহাকার চলছে। তিন দিন ধরে শতাধিক গ্রাম বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। আর চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়ক এখনো পানিতে টইটম্বুর হওয়ায় এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ রয়েছে। চলমান পাহাড়ি ঢল আর টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট এই বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাতকানিয়া উপজেলা।
এই উপজেলার সতেরোটি ইউনিয়ন তলিয়ে গেছে। সেখানে পানিবন্দি আছেন দুই লক্ষাধিক মানুষ। বিদ্যুৎ সাব- স্টেশন পানিতে ডুবে যাওয়ায় দুই দিন ধরে বন্ধ রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ।
বন্ধ হয়ে গেছে মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক। পানি বেড়ে যাওয়ায় স্বজনরা যোগাযোগ করতে পারছে না পানিবন্দি মানুষের সঙ্গে। পানির প্রবল স্রোতের কারণে নৌকা যেন সোনার হরিণ। সংকট দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের মৌলভীর দোকান থেকে সাতকানিয়া রাস্তার মাথা পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার সড়কের উপর অন্তত পাঁচ ফুট পানি প্রবাহিত হচ্ছে। কোথাও বুক আবার কোথায় কোমর সমান পানি। বানের পানিতে পানিতে ভাসছে সাতকানিয়ার প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা কেরানীহাট, সাতকানিয়া সদর। কোমর পরিমাণ পানিতে ডুবে গেছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সাতকানিয়া থানা ভবন। সংকট দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির। এ অবস্থায় পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারে কাজ করছে সেনাবাহিনী। তবুও পানির পরিমাণ বেশি হওয়ায় বেগ পোহাতে হচ্ছে তাদের। সাতকানিয়ার পাশাপাশি লোহাগাড়া, চন্দনাইশ ও বাঁশখালীর অনেক এলাকা এখনো আছে পানির নিচে। সেখানেও অনেক গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। শুকনা খাবার ও বিশুদ্ধ পানির জন্য চলছে হাহাকার।
লোহাগাড়ার বড় হাতিয়া এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ ওমর ফারুক মাসুম বলেন, তিন দিন ধরে আমরা পানিবন্দি। এলাকায় বিদ্যুৎ নেই গতকাল থেকে। মোবাইলের নেটওয়ার্ক আসতেছে- যাচ্ছে। কোমর সমান পানি হওয়ার পরেও অনেকে বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে যাচ্ছেন না। তারাই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়ছেন। ঘরে খাবার নেই, বিশুদ্ধ পানি নেই। তিনি বলেন, প্রশাসন থেকেও সেভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে না। আবার পানি বেশি হওয়ায় অনেকে চাইলেও সহযোগিতা করতে আসতে পারছেন না। যে কারণে এখানকার মানুষের মধ্যে অনেকটা হাহাকার চলছে। আর বৃষ্টি কমলেও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনে পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকাই পানি সেভাবে সরছে না।
লোহাগাড়ার আমিরাবাদের বাসিন্দা মোহাম্মদ সাজ্জাদ বলেন, ‘কয়েক দিনের টানা ভারী বর্ষণ ও খালের বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় আমাদের এলাকার বেশির ভাগ মানুষ এখনো পানিবন্দি। আমিরাবাদ ইউনিয়নের মল্লিক ছোবহান আমাদের হাজির পাড়ার যতগুলো কাঁচা ঘরবাড়ি ছিল সবই বন্যার পানিতে ভেঙে গেছে। বিশেষ করে আমার বাড়িসহ আমার পাড়ার ২০/২৫ টি বাড়ির কেউ একটা শুকনা কাপড় নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে পারেনি। বাড়ির সব মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। সবাই খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। জ্বলছে না চুলায় আগুন। বিদ্যুৎ নেই, খাবার পানি নেই। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় আমাদের এলাকায় এখনো পর্যন্ত কোনো জনপ্রতিনিধি বা সরকারি সংস্থার পা পড়েনি। তারা খবর নেয়ারও কোনো প্রয়োজন মনে করেনি।’
এদিকে বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়ে সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ায় দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া মোহাম্মদ তানভীর উদ্দিন (২০) নামে সাতকানিয়ার এক কলেজ শিক্ষার্থী এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। তানভীর গত মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলার মির্জাখীলের বার্মা মার্কেট এলাকায় বন্যার পানিতে ভেসে যান। তিনি সাতকানিয়া পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের ঘাটিয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা। উপরন্তু টানা বর্ষণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক পানিতে ডুবে যাওয়ায় এখনো স্বাভাবিক হয়নি যান চলাচল। মহাসড়কের অন্তত ৪টি স্থানে তৈরি হয়েছে যানজট। সড়কের উভয়প্রান্তে আটকে পড়েছে কয়েকশ’ ছোট-বড় যানবাহন। গতকাল বিকাল ৫টায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। একই কারণে চট্টগ্রামের সঙ্গে বান্দরবানের সড়ক যোগাযোগও বন্ধ রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, চন্দনাইশের জোয়ারা খানহাট থেকে গাছবাড়িয়া পর্যন্ত আটকে পড়েছে শতাধিক যানবাহন। এ ছাড়া বাগিচারহাট, দোহাজারী, সাতকানিয়া মৌলভী দোকান, কেরানীর হাট বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত রয়েছে তীব্র যানজট। অন্যদিকে কেরানীরহাট থেকে বান্দরবান সড়কের বাজালিয়া এলাকায়ও যানজট দেখা দিয়েছে।
চন্দনাইশের ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিমরান মোহাম্মদ সায়েক জানান, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের চন্দনাইশের হাশিমপুর, দোহাজারী, কেরানীহাটসহ বিভিন্ন এলাকা এখনো জলমগ্ন। তাই যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। পানি কমলে আবার স্বাভাবিকভাবে গাড়ি চলবে।